অরণ্যের জননী

কেরুনতলীতে বনরক্ষী দলের সঙ্গে নিজের বাড়ির সামনে খুরশিদা বেগম। ছবি: সৌরভ দাশ
কেরুনতলীতে বনরক্ষী দলের সঙ্গে নিজের বাড়ির সামনে খুরশিদা বেগম। ছবি: সৌরভ দাশ

কেরুনতলী গ্রামের নাম শুনেছেন?
দক্ষিণে বাংলাদেশের শেষ সীমানা টেকনাফ। টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের সাধারণ এক গ্রাম কেরুনতলী। খুরশিদা বেগমের কারণে এই গ্রামটির নাম আজ অনেকেই জানেন। এই গ্রামের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা এক মেয়ে ইতালির রোম শহর থেকে যেদিন ‘ওয়াংগারি মাথাই’ পুরস্কার নিয়ে ফিরে এসেছিলেন, সেদিন গ্রাম ও আশপাশের এলাকা তো বটেই, সারা দেশের মানুষের চোখেও বিস্ময়! জাতিসংঘের এই পুরস্কারের আর্থিক মূল্যও তো কম নয়, ১৭ লক্ষ টাকা। কী এমন করেছেন খুরশিদা যে সারা পৃথিবীতে পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন এমন পাঁচ শ নারীকে পেছনে ফেলে পুরস্কারের জন্য বাছাই করা হলো তাঁকে?

সে কথায় পরে আসছি। আগে কেরুনতলী গ্রামটি নিয়ে একটু বলি। প্রকৃতি বড় সুন্দর করে সাজিয়েছে গ্রামটিকে। সামনে নাফ নদী, পেছনে শাল-সেগুন-গর্জনসহ নানা জাতের গাছ-গাছালিতে ভরা ঘন পাহাড়ি অরণ্য। পাহাড়ের ঢালে যেটুকু সমতল ভূমি, তাতে শ দুয়েক পরিবারের বাস। বন বিভাগের কল্যাণে গ্রামে বিদ্যুতের আলো আছে, কিন্তু শিক্ষার আলো নেই।

এই গ্রামের দরিদ্র লোকমান আলীর মেয়েটি পড়াশোনা করতে চায়। কিন্তু মেয়ের আবদার মেটানোর উপায় ছিল না তাঁর। কোথায় পড়বে? গ্রামের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো স্কুল নেই তখন। কিন্তু খুরশিদা নাছোড়বান্দা। শেষে মেয়ের জেদ রক্ষা করতে স্কুলে পাঠাতে হলো তাকে। তিন কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে বাজার পর্যন্ত গিয়ে, সেখান থেকে চাঁদের গাড়িতে (ছাদবিহীন লক্কড়-ঝক্কড়মার্কা জিপ) চেপে স্কুলে যেতে শুরু করল খুরশিদা। প্রথমে মায়মুনা প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পরে এজাহার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছিল। কেরুনতলীর একটা মেয়ে যে এটুকু পারল, তা-ই হয়তো অনেক। গ্রামে একটা স্কুল গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিল মেয়েটি।

এখানে থেমে গিয়েছিল খুরশিদার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। কিন্তু স্বপ্নটা থামেনি। বুকের তলায় চাপা পড়েছিল শুধু। এরমধ্যে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ব্র্যাক’ একটি প্রাইমারি স্কুল চালু করল কেরুনতলী গ্রামে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ জন। কিছুদিন সেই স্কুলে শিক্ষকতা করলেন।

অল্প বয়সে বিয়েথা করে সংসারি হবেন এমন ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু গ্রাম-সমাজের বাস্তবতায় ১৬ বছরের কিশোরীটির বিয়ে হয়ে গেল। তখন ২০০১ সাল। তবে সান্ত্বনা এই, স্বামী মোহাম্মদ ইসলাম ‘শিক্ষিত’। এই গ্রামে তিনি ছাড়া এসএসসি পাস আর কোনো যুবক ছিল না বলে ‘মাস্টার ইসলাম’ নামে পরিচিতিও ছিল তাঁর। খুরশিদার নানা রকম সামাজিক কাজের আগ্রহকে সমর্থন জোগাতেন মোহাম্মদ ইসলাম। স্বামীর উৎসাহ পেয়ে গ্রামে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আবার চাড়া দিয়ে উঠল মনে। সেই সুযোগটাও এসে পড়ল একদিন। টেকনাফ নিসর্গ বনরক্ষা সহব্যবস্থাপনা কমিটিতে সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ২০০৪ সালে। এবার তাদের সহযোগিতায় গড়ে তুললেন কেরুনতলী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাঁশের বেড়া আর গোলপাতার ছাউনির স্কুলঘর। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বিনা বেতনে শিক্ষকতা করতেন সেই স্কুলে। দেখতে দেখতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে গেল। স্বপ্নটাকে আরও একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে তখন। এর মধ্যে ২০১০ সালে হঠাৎ মারা গেলেন মোহাম্মদ ইসলাম। খুরশিদা বেগম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন কিছুটা। কিন্তু লক্ষ্য থেকে সরলে তো চলবে না। মাস্টার ইসলাম নেই, স্কুলটা তো আছে। সহশিক্ষক খুরশিদা তাই বিনা বেতনে শিক্ষকতার কাজটি করে যাচ্ছেন এখনো।

শুরুতে ‘ওয়াংগারি মাথাই’ পুরস্কারের কথা বলেছিলাম। সেই প্রসঙ্গে আসি। খুরশিদা বেড়ে উঠেছেন পাহাড়-অরণ্যবেষ্টিত গ্রামে। গ্রামের সীমানা ঘেঁষে বনটিতে ছোটবেলায় বন্য প্রাণির অবাধ যাতায়াত দেখেছেন। গভীর বনে থাকা আরও ভয়ংকর সব বন্য প্রাণীর গল্প শুনেছেন বড়দের কাছে। ঘুম ভাঙত পাখির গানে। কত রঙের পাখি যে দেখেছেন তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু চোখের সামনেই যেন বদলে যাচ্ছিল সেই দৃশ্য। বড় বড় গাছ কেটে নেওয়ার জন্য দলে দলে বহিরাগত লোক ঢুকতে শুরু করল বনের ভেতরে। দেখাদেখি গ্রামের নারী-পুরুষও কাঠ সংগ্রহের জন্য সারাটি দিন দা হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বনে। উজাড় হয়ে যাচ্ছিল বন। বন বিভাগের লোকজন পাহারা দিয়েও এসব বন্ধ করতে পারছিলেন না।

কীভাবে এর প্রতিকার করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে গিয়ে প্রথমেই ঠিক করলেন আগে বোঝাতে হবে গ্রামের বউ-ঝিদের। তাঁদের সঙ্গে এ বিষয়ে দিনের পর দিন কথা বলেছেন, উঠানবৈঠক করেছেন। তারপর গড়ে তুলেছেন নারী বনরক্ষা দল। সেটা ২০০৬ সাল। খুরশিদার নেতৃত্বে ২৮ জন নারীর এই দল সকালে ও বিকেলে দুই ঘণ্টা করে সাতটি দলে বিভক্ত হয়ে বন পাহারা দেওয়া শুরু করল।

বলা হলো বটে শুরু করল, কিন্তু কাজটা যে কত দুরূহ ছিল কল্পনা করাও কঠিন। প্রথমত, বনদস্যুরা তাদের চারণক্ষেত্রটি বিনা বাধায় ছেড়ে যেতে রাজি ছিল না। দ্বিতীয়ত, গ্রামের মানুষ তাদের সহজে উপার্জনের পথটি বন্ধ হতে দেবে না। সর্বোপরি অজপাড়াগাঁয়ের কিছু নারী ছড়ি ঘোরাবে, এটাই বা সহ্য করবে কেন গ্রামবাসী? কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে এগোতে হয়েছে খুরশিদা বেগমের বাহিনীকে। স্থানীয় অধিবাসীদের বোঝাতে হয়েছে যে বন বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী পরিণত বয়সের গাছ কাটার পর কাঠ বিক্রির একটি লভ্যাংশ তাদের মধ্যেও বিতরণ করা হবে। প্রতিদিনের লাকড়ি বিক্রির টাকার চেয়ে সেই লাভের অঙ্ক অনেক বেশি।

এভাবে ধীরে ধীরে নারী বনরক্ষী দলের সঙ্গে গ্রামবাসীর একটা সমঝোতা ও সখ্য গড়ে উঠল। কাঠ কাটা বন্ধ হলো। ২০০৬ সাল থেকে নারী বনরক্ষী দলের নেতৃত্ব দিয়ে বন তথা পরিবেশ রক্ষার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১২ সালে খুরশিদা বেগম অর্জন করেছেন ‘ওয়াংগারি মাথাই’ পুরস্কার।

‘পুরস্কার’ অবশ্য এর আগেও পেয়েছেন খুরশিদা। এলাকাবাসীর ভালোবাসার পুরস্কার। ২০১১ সালে টেকনাফ সদর ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ইউপি সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তিনি। তত দিনে এলাকার মানুষের কাছে একটা অদম্য ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে খুরশিদা বেগমের। ফলে চারজন পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

পুরস্কার পাওয়ার পর অতিক্রান্ত হয়েছে পাঁচটি বছর। এখন কেমন আছেন খুরশিদা? এখনো কি তৎপর আছে তাঁর বনরক্ষী দল? এই কৌতূহল থেকে সম্প্রতি গিয়েছিলাম টেকনাফের কেরুনতলীতে। বাড়িটি খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। কেরুনতলী গ্রামে এই বাড়ি কে না চেনে। কিন্তু পড়েছি এক মধুর সমস্যার সামনে। খুরশিদা মা হয়েছেন। দ্বিতীয় স্বামীর ঘরের প্রথম সন্তানটি তাঁর কোলে এসেছে মাত্র ১০ দিন আগে। এই অবস্থায় তিনি কথা বলতে রাজি হবেন কি না, সেই সংশয় ছিল। কিন্তু অনেক দূর থেকে এসেছি শুনে হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন খুরশিদা।

জানতে চাইলাম, ‘আপনার দলের কাজ কেমন চলছে?’

তিনি বনে যাওয়ার পথটা চিনিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনারা আগে নিজের চোখে দেখে আসুন। ঘুরে এখানে আসবেন।’

আমাদের আলোকচিত্রী সৌরভ দাশ, টেকনাফ প্রতিনিধি গিয়াসউদ্দিন আর বন বিভাগের কর্মচারী শহীদুল হককে নিয়ে গ্রামের সরু পথ পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম পাহাড়ি অরণ্যে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে তখন। বনে বড় বড় শাল-সেগুন-গর্জন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বড় ভালো লাগল। দূরে অরণ্য আরও ঘন ও গভীর। পাখির সুর প্রতিধ্বনি তুলছে পাহাড়ে। সেই সুর ছাপিয়ে তীব্র এক হুইসেল শোনা গেল হঠাৎ। সেই আওয়াজ অনুসরণ করে দেখতে পেলাম লালপেড়ে সবুজ শাড়ি, কারও কারও গায়ে সবুজ অ্যাপ্রন, হাতে বাঁশি আর লাঠি হাতে একদল নারী ঘুরে বেড়াচ্ছেন বনের ভেতরে।

কথা হলো সেই দলের নূরজাহান বেগম, শাহানা আক্তার, জোহরা বেগম, চেমন খাতুন, হাসিনা বেগমদের সঙ্গে। তাঁরা সবাই এক বাক্যে জানালেন, এখন আর কাঠ চোরেরা ঢোকে না বনে। স্থানীয় লোকজনও মনে করে এই বন তাদের সম্পদ। হাতি, বানর, মেছোবাঘ, হরিণ, শূকরসহ নানা রকম পশু অবাধে ঘুরে বেড়ায় জঙ্গলে।

বনরক্ষী দলের সবাইকে নিয়ে আবার ফিরে এলাম খুরশিদার বাড়িতে।

খুরশিদা জানতে চাইলেন, ‘কী দেখলেন?’

আমাদের উত্তরটা হয়তো তাঁর জানা, তাই হাসিতে উদ্ভাসিত মুখ। বললেন, ‘আমাদের দেখাদেখি শীলখালী আর চুনতিতেও এখন গড়ে উঠেছে নারী বনরক্ষী দল। দেখবেন একসময় সারা দেশেই এ রকম সচেতনতা গড়ে উঠবে। তখন আর বন উজাড় হওয়ার সংবাদ ছাপা হবে না পত্রপত্রিকায়।’

ফিরে আসার সময় বললাম, ‘স্বামী এবং তিন সন্তান নিয়ে এখন তো বেশ সুন্দর সংসার আপনার...।’

খুরশিদা বললেন, ‘আমার সন্তান তো চারটি।’

একটু বিস্মিত হয়েছিলাম। হিসাব মিলছে না। আগের ঘরের দুটি সন্তান সাইফুল আর আরশাদ, দ্বিতীয় ঘরে একটি—তোফা। চারটি হয় কী করে?

আমার বিভ্রান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে সলজ্জ হেসে খুরশিদা বললেন, ‘আমার আর একটি সন্তানের নাম অরণ্য।’

অষ্টম শ্রেণি পাস নারীটির এই রসবোধ যুগপৎ বিস্মিত ও মুগ্ধ করল আমাদের। খুরশিদা বেগম ও তাঁর নারী বনরক্ষী দলটিকে দেখে নতুন করে উপলব্ধি হলো, এ দেশের মাটিতে সঞ্জীবনের শক্তি আছে। এই শক্তিই জাগিয়ে রাখবে, বাঁচিয়ে রাখবে বাংলাদেশকে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি ও কথাসাহিত্যিক; সাংবাদিক।