কাগজের রং দেখে নাচে ওরা

এই শিশুরা কানে শোনে না। কথাও বলতে পারে না। অথচ গানের তালে দিব্যি নেচে যাচ্ছে। মুদ্রায়ও ভুল নেই। এর কারণ বিশেষ কৌশল। একেক রঙের কাগজে একেক মুদ্রা অনুসরণ করছে তারা। একেক রঙের কাগজ দেখাচ্ছিলেন একজন নির্দেশক।     

২৬তম আন্তর্জাতিক এবং ১৯তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবসে বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে গতকাল রোববার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠান হয়। সেখানে বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুরা নৃত্য পরিবেশন করে। প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ অন্য অতিথিরা প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।

অনুষ্ঠান শেষে কথা হলো শিশুদের নাচের বিশেষ কৌশল নিয়ে। তারা এসেছে সাভার থেকে। সাভারে বেসরকারি সংগঠন একসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে তারা পড়াশোনাসহ বিভিন্ন সুযোগ পাচ্ছে। সেখানে নাচও শেখানো হয়। অনুষ্ঠান শেষে শিশুদের চোখেমুখে ছিল আনন্দ। সেই আনন্দে নিজেদের মধ্যে ইশারা ভাষায় নানান কথা বলছিল। একসেস বাংলাদেশে কর্মরত ব্যক্তিদের কাছ থেকে সেই আলাপের বিষয়বস্তু বুঝে নিতে হয়। হাসিমুখে অনেকেই জানিয়ে দিল, নাচতে খুব ভালো লাগে। অতিথিরা যখন হাততালি দেন, তখন খুব ভালো লাগে।

এই শিশুদের কোরিওগ্রাফার অনিকেত পালের মুখেও তৃপ্তির হাসি। তিনি বলেন, কাগজের রং পরিবর্তন হলে ওরা বুঝতে পারে নাচের কোন মুদ্রাটা করতে হবে। ওদের চোখ থাকে কাগজের দিকে। অন্যদিকে তাকালে তারা আর তাল মেলাতে পারবে না। এদের দিয়ে শুধু নাচ নয়, থিয়েটারে অভিনয় করানোর পরিকল্পনা আছে। সেভাবেই ওদের প্রস্তুত করা হচ্ছে। ১৬ জনকে নিয়ে সাংস্কৃতিক দল গঠন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে নেচেছে আটজন।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে নাচছে বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুরা l ছবি: প্রথম আলো
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে নাচছে বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুরা l ছবি: প্রথম আলো

শিশুদের নাচের সময় মঞ্চের নিচে দাঁড়িয়ে হাতের বিভিন্ন রঙের কাগজ পরিবর্তন করছিলেন রোবাইয়া আক্তার। তিনি অনিকেত পালের সাংস্কৃতিক দলের সহকারী এবং একসেস বাংলাদেশ পরিচালিত স্কুলে (৩ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের জন্য) শিক্ষকতা করছেন। নাচের সময় অনিকেত পাল এবং রোবাইয়ার মুখের অভিব্যক্তি দেখে শিশুরাও অভিব্যক্তি পরিবর্তন করে। এ ছাড়া কোনো গানের সঙ্গে নাচের প্রশিক্ষণের আগে ইশারা ভাষায় শিশুদের কাছে গানের পুরো কথা তাঁরা বর্ণনা করেন, যা নাচে সহায়তা করে।

১৮ বছর বয়সী কেয়া দাসের মা সন্ধ্যা রাণী দাস হাসতে হাসতে জানালেন, তিনি কখনো কল্পনাও করেননি তাঁর মেয়ে মঞ্চে নাচতে পারবে। সন্ধ্যা রাণীর ৯ বছর বয়সী আরেক মেয়েও কথা বলতে পারে না। নিজের এক ভাইয়েরও একই অবস্থা।

শাহানা বেগম নাতনি আলিফাকে (বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী) নিয়ে সংগ্রাম করছেন। আলিফার মা সাভারের রানা প্লাজায় কাজ করতেন। দুর্ঘটনার পর শাহানা বেগম মেয়ের লাশটাও পানটি। মেয়ের স্বামী আলিফা ও আলিফার এক ভাইকে রেখে চলে গেছেন।

অনুষ্ঠানে লিপি বেগম এসেছেন বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী মেয়ে ও নাতিকে নিয়ে। শুধু নিজের মেয়ে ও ছেলের ঘরের নাতিই নয়, এই নাতির বাবাও কথা বলতে পারেন না।

শারীরিক প্রতিবন্ধী মহুয়া পাল একসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানালেন, সাভার পৌরসভার ৫৬টি পরিবারের বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশু ও যুবদের নিয়ে বিভিন্ন কাজ হচ্ছে। যুব ক্লাব পরিচালনা করা হচ্ছে। পৌরসভার ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ইশারা ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে। বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২২ জন মূলধারার স্কুলে অষ্টম শ্রেণিসহ বিভিন্ন শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। সংগঠনের পক্ষে মার্থা রায় মূলধারার স্কুলে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়ে পড়াশোনায় সহায়তা করছেন। এসব কাজে ডেফ চাইল্ড ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ও সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) সহায়তা করছে।