সাবিনা ঘুম ভেঙে দেখ, কাপ জিতে আনছি

সাবিনার মায়ের সঙ্গে তার দুই সঙ্গী তহুরা ও শামসুন্নাহার। ছবি: প্রথম আলো
সাবিনার মায়ের সঙ্গে তার দুই সঙ্গী তহুরা ও শামসুন্নাহার। ছবি: প্রথম আলো

মনের এক পিঠে শিরোপা জয়ের উৎসব, অপর পিঠে অকালে চলে যাওয়া বন্ধু সাবিনাকে হারানোর দুঃখ। সেই পুতুলের বিয়ে দেওয়ার বয়স থেকে তাদের বন্ধুত্ব। শৈশবের সেই বন্ধুর মৃত্যু ঘটেছে চোখের সামনে। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ তো আর এত তাড়াতাড়ি থামার নয়, থামছেও না। তাই মেয়েদের শিরোপা উৎসবের মধ্যেও কোথায় যেন বাজছে বিরহী সুর।
সবেই অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ঘরে ফিরেছে ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া থানার কলসিন্দুরের মেয়েরা। চ্যাম্পিয়ন দলের আট মেয়ের বাড়ি এই কলসিন্দুরে। মারিয়া মান্দা, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহাররা রাত করে বাড়ি ফেরার পর অপেক্ষা ছিল সকালের। সূর্যের আলোটা একটু পরিষ্কার হতেই সবাই ছুটেছে সাবিনার বাড়ি।
সে তো আর নেই। আগেই ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। নইলে থাকত শিরোপা উৎসবে। কিন্তু সাবিনার স্মৃতি তো আছে, বন্ধুর বাড়িতে বসে তার সঙ্গে কত গল্প, কত কথা, শত শত সুখ-দুঃখ বিনিময় করে নেওয়া। সেসব স্মৃতির পৃষ্ঠা উল্টেই মেয়েরা অভিমানী নালিশ জানাবে ‘বেইমান’ ভাগ্যের কাছে।
সাবিনা ইয়াসমিন—বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের মন থেকে নামটি দ্রুত মুছে যাওয়ার কথা নয়। গত ২৬ সেপ্টেম্বর জ্বরে ভুগে অকালে ঝরে পড়ে কলসিন্দুরের এই নারী ফুটবলার। মারিয়া মান্দা, তহুরাদের সঙ্গে পুতুল খেলা থেকে ফুটবল খেলা (অনূর্ধ্ব-১৫ দল) পর্যন্ত সঙ্গী ছিল সাবিনা। এরপর পাড়ি জমিয়েছে না-ফেরার দেশে। ঢাকার ক্যাম্প থেকে ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে মেয়েটি সেই যে জ্বরে পড়ল, আর উঠল না। যদি উঠত, তাহলে সেদিনের সোনামাখা বিকেলে ভারতকে হারিয়ে বিজয় উৎসবের মিছিলে সাবিনাও থাকত।
নেপালের বিপক্ষে ৬-০ গোলের জয়ে শুরু হয়েছিল অনূর্ধ্ব-১৫ দলের সাফ অভিযান। সে ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিল তহুরা। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকানো যায়নি। এতটুকু একটা মেয়ে বুকে পেশাদারত্বের পাথর বেঁধে হ্যাটট্রিক করলেও মুখটা বন্ধু হারানোর ব্যথায় কাতর। ওই ম্যাচে তো দুজনেরই খেলার কথা ছিল! সাবিনা কথা রাখেনি। মাঠে নামার আগে তহুরা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ‘সাবিনা, তোর জন্য হলেও শিরোপা ছিনিয়ে আনব।’
তহুরার ঘরে এখন সেই শিরোপার দ্যুতি। পাশেই সাবিনার ঘরে হাহাকার। হাত-ধরাধরি করে বেড়ে উঠেছে দুই বন্ধু। সকালে স্কুলে যাওয়া থেকে বিকেলে ফুটবল অনুশীলন—সবই একসঙ্গে হওয়ায় দুজনে ছিল ‘মানিকজোড়’। সেই ‘জোড়’ এমনই যে সাবিনা যেদিন মারা গেল, সে রাতেও দুজন একসঙ্গে ঘুমিয়েছিল। দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেও সাবিনাকে ধরে রাখতে পারেনি তহুরা। তার হাতেই সাবিনার শেষনিশ্বাস ত্যাগ।
সাবিনার বাড়ির উঠোনে বসে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে সেই ঘটনা শোনাল তহুরা, ‘সন্ধ্যার আগে আমি সাবিনাদের বাড়ি যাই। ও আমাকে বলল, তুই চাচিকে বলে আমার সঙ্গে ঘুমাবি। আমি মাকে বলে চলে এলাম রাতেই। পরের দিন সকালে ও বেশি অসুস্থ হলে আমিই ওকে কোলে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বের হই।’ তহুরার চোখ দুটি জলে টলমল।
ফাইনালের গোলদাতা শামসুন্নাহারও সাবিনার প্রতিবেশী। স্কুল আর ফুটবল মাঠে দুজনের যাওয়া-আসা ছিল একসঙ্গে। সাফ জয়ের নায়িকা গোটা টুর্নামেন্ট খেলেছে বন্ধুকে বুকে ধারণ করে। লাল-সবুজ জার্সিটা গায়ে চাপানোর সময় শামসুন্নাহারের মনে হয়েছে, সাবিনা যেন অলক্ষ্যে পাশ থেকে বলেছে, ‘ভালো খেলিস, বোইন।’ শামসুন্নাহার শুধু ভালোই খেলেনি, দেশকেও করেছে চ্যাম্পিয়ন। ফাইনালে গোলের পর সবার আগে তাঁর মনে পড়েছে সাবিনার কথা, ‘গোলটা যখন দিলাম, সবার আগে সাবিনার কথা মনে পড়েছে। ও বেঁচে থাকলে তো আমরা সবাই একসঙ্গে হুড়োহুড়ি করতাম।’
তহুরা-শামসুন্নাহারের এই স্মৃতিচারণার মধ্যে সাবিনার বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে অধিনায়ক মারিয়া মান্দা ও নাজমা। ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল বিজয়ী কিশোরীরা। বাড়িতে যেহেতু পাওয়া গেল না, যেতে হবে ওর আসল (কবরের) ঠিকানায়। ঘুম ভাঙিয়ে বলতে হবে, ‌‘সাবিনা, দেখ, তোর জন্য কাপ জিতে আনছি।’