বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে...

অন্ন দাস
অন্ন দাস

বান্দরবান শহরের কাছে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের নাম নীলাচল। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, পাহাড় আকাশ ছুঁয়েছে। তাই স্থানীয় নাম নীলাচল। এখানে এলে যেকোনো পর্যটক ঢোলের বাজনা ও গানের সুর শুনবেন। যিনি ঢোল বাজিয়ে গান গেয়ে শোনান, তাঁর নাম অন্ন দাস। তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।

অন্ন দাস আপন মনে গান গাইতে থাকেন। কারও কাছে কিছু চান না। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি পর্যটকদের যদি গান বা ঢোলের বাজনা ভালো লাগে, তাহলে কেউ ১০/২০ টাকা, কখনো ১০০ টাকাও দেন। দিন শেষে টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় কখনো ১০০ টাকা, আবার কখনোবা ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর এ দিয়েই চলে অন্ন দাসের সংসার।

অন্ন দাস সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পান। ৩০০ টাকা করে ছয় মাসের ভাতা একবারে তোলেন। সংসারে তাঁর স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে আছে। ছেলেমেয়েদের কেউ না কেউ প্রতিদিন বাবার সঙ্গে নীলাচলে আসে, তাই তারা পড়াশোনা করতে পারেনি।

২০০৬ সাল থেকে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে চালু হয়। ২৩ ডিসেম্বর বিকেলে নীলাচলে অন্ন দাস শিল্পী শাহ আবদুল করিমের গান—‘গান গাই আমার মনরে বুঝাই...’ ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে...’—একটার পর একটা গেয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে সিঁড়িতে বসেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। রেডিও, টেলিভিশনে গান শুনে শুনেই তাঁর শেখা। অনেক সময় পর্যটকদের কেউ কেউ তাঁদের পছন্দের কোনো গান শুনতে চান। তা না পারলে অন্ন দাস বলে দেন, তিনি ওই গান গাইতে পারেন না।

অন্ন দাস বললেন, গান শুনে সবাই তো আর টাকা দেয় না। মন চাইলে কেউ কেউ দেয়। অন্ন দাস জানালেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছোট ছিলেন। পরিবারের সঙ্গে ভারতে যাওয়ার পথে তাঁর জ্বর হয়। কিন্তু চিকিৎসা করার উপায় ছিল না। চিকিৎসার অভাবে একসময় দুই চোখই নষ্ট হয়ে যায়। এখন চোখের সামনে শুধু আলোর একটি উপস্থিতি অনুভব করতে পারেন, আর কিছু নয়।

অন্ন দাসের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার ধর্মপুর গ্রামে। প্রতিদিন দুপুরে পৌঁছে যান নীলাচলে। সন্ধ্যার আগে আগে তিনি তাঁর ঢোল নিয়ে বাড়ির পথ ধরেন। বাড়ি থেকে নীলাচল আসা-যাওয়া বাবদ প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে। প্রতিদিন ছেলে বা মেয়েসহ দুজনের আসা-যাওয়া বাবদ খরচও একদম কম না।

অন্ন দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্য সময় যেমন-তেমন, বর্ষাকালে খুব কষ্ট হয়। এক দিন খাই তো আরেক দিন না খাইয়া থাকতে হয়।’

নীলাচলের সিঁড়িতে বসে গান গাওয়ার জন্য কাউকে কোনো টাকাপয়সা দিতে হয় না। তবে বর্তমানে স্থানীয় কয়েক যুবক অন্ন দাসকে বিকেল পাঁচটার আগেই নীলাচল থেকে চলে যেতে বলছেন। না গেলে নাকি তাঁকে এখানে আর বসতে দেওয়া হবে না।

নীলাচলে পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে ছবি বা সেলফি তুলে একেকজন যখন চলে যাচ্ছেন, তখনো অন্ন দাস ঢোল বাজিয়ে গান গেয়েই চলেছেন। নীলাচলের প্রকৃতির সঙ্গেই যেন মিশে আছে অন্ন দাসের সুর।