অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এ কেমন আয়োজন?

বাথরুম অপরিষ্কার। সাফসুতরো করা হয়নি অনেক দিন। নোংরা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। ওয়ার্ডের ভেতরে চারপাশই নোংরা। ফ্যান ঘোরে না। ঘুরলেও বাতাসের চেয়ে শব্দ বেশি। বেশির ভাগ বাতিই জ্বলে না। ওয়ার্ডের ভেতরই ভাঙা খাটসহ অন্যান্য আসবাব রাখা। জানালা খোলা যায় না। জানালার অধিকাংশ কাচ ভাঙা। দিনের বেলায়ও মশার হাত থেকে বাঁচতে অনেকে মশারি টানিয়ে রেখেছেন। 

এ চিত্র রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ডের। ১৯৭২ সালে এ প্রতিষ্ঠানে দোতলা একটি ভবনে চালু করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের ওয়ার্ড। নিচতলায় সাধারণ ওয়ার্ড, দোতলায় কেবিন। ১৬টি কেবিনসহ মোট ৪০টি শয্যা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ। বর্তমানে প্রায়ই অর্ধেক শয্যা খালি থাকে। কিন্তু নিয়ম নেই বলে এখানে অন্য রোগীদের ভর্তি করা হয় না।

হাসপাতালের বিছানায় বসে আছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ছবি: প্রথম আলো
হাসপাতালের বিছানায় বসে আছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ছবি: প্রথম আলো


গত মঙ্গলবার মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি ছিলেন ২৪ জন। এখানে কয়েকজন ‘ভালো’ রোগীও কাগজে-কলমে ভর্তি আছেন। তাঁদের কেউ কেউ তাঁদের নামে বরাদ্দ করা কেবিন তালা দিয়ে চাবি নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। শুধু তালার চাবি নিয়ে গিয়েছেন তা-ই নয়, হাসপাতালে রোগীর যে ফাইল থাকে, তা-ও সঙ্গে নিয়ে গেছেন।

চিকিৎসা নিতে এসে মুক্তিযোদ্ধারা কেমন আছেন, তা জানতে চাইলে জামালপুর, দিনাজপুর, ঝিনাইদহ, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা একেকজন মুক্তিযোদ্ধার মুখে রাগ, দুঃখ, কষ্ট, অভিমানের ছায়া ঢেউ ভাঙতে থাকে। অভিমান করে অনেক মুক্তিযোদ্ধা কথা বলতে চাননি। তবে ওয়ার্ড থেকে চলে আসার পর বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা প্রতিবেদকের মুঠোফোনে নানা অভিযোগ জানাতে থাকেন। তাঁরা বলেন, এখানে তাঁদের অনেকটা ‘জন্তু জানোয়ার’ বলে মনে করা হয়। তাঁদের প্রশ্ন, ‘আমরা কি জন্তু জানোয়ার?’ ফ্যান চলে না বলে একেকজন সঙ্গে করে ছোট ফ্যান নিয়ে এসেছেন। হাসপাতালের মশারি ছেঁড়া বলে রোগীরা নতুন মশারি কিনেছেন। শৌচাগারে যেতে পারেন না বলে একজন প্লাস্টিকের কমোড চেয়ার সঙ্গে করে এনেছেন।

ভবনটির দোতলায় একটি বিনোদনকক্ষ আছে। সেখানে ছোট একটি টেলিভিশন ও রিমোট আছে। চেয়ারগুলো ভাঙা। একজন মুক্তিযোদ্ধা টেলিভিশন কিনে দিয়েছেন, এখন অন্যরা ডিশ সংযোগের বিল দিয়ে টেলিভিশন দেখছেন।
রোগীদের অভিযোগ, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ডে সিট ভাড়া দেওয়াসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজের সঙ্গেও জড়িত। গুটিকয়েক মুক্তিযোদ্ধার জন্য অন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।


রোগীরা জানালেন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড থাকলেও এখানে চরম অবহেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ওয়ার্ডের ওয়ার্ড বয়সহ অন্যরা ‘আপনি’ করে কথা বলে খুব কম সময়। টাকা দেওয়া ছাড়া বাথরুম পরিষ্কার থেকে শুরু করে কোনো কাজ কর্মীরা করেন না। বিনা মূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার কথা থাকলেও বেশির ভাগ ওষুধ নিজেদের কিনতে হয়। মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ড বা কেবিনে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই।


মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ডে ঢুকতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে বাংলাদেশের একটি রংচটা জাতীয় পতাকা এবং পাশে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একটি পতাকা। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একটি বড় সাইনবোর্ড উল্টো হয়ে ঝুলছে নিচতলার বারান্দার রেলিংয়ে।

হাসপাতালের দেওয়া খাবার নিয়ে আছে নানা অভিযোগ। হাসপাতাল থেকে শুধু রোগীর খাবার দেওয়া হয়। একাধিক মুক্তিযোদ্ধা জানালেন, একসময় উন্নত মানের খাবার দেওয়া হলেও এখন দেওয়া হয় অত্যন্ত নিম্নমানের খাবার। তাঁদের প্রশ্ন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কি সরকারের আলাদা বরাদ্দ নেই? একজন বললেন, ‘মোটা চাউলের যে ভাত দেয়, তা আমাদের গলা দিয়ে নামে না।’ বিশেষ কায়দায় স্টাফদের সঙ্গে কিছু রোগীর যোগসাজশে এ খাবার আবার বেচাকেনাও হয় বলে জানা গেল। এ প্রক্রিয়ায় ওয়ার্ডের ইনচার্জ জড়িত বলেও অভিযোগ করেন কয়েকজন।

একেক রোগীর সঙ্গে কমপক্ষে পরিবারের দুজন সদস্য থাকেন। ওয়ার্ডের মধ্যে গ্যাসের চুলায় রান্না করেন স্বজনেরা। হাঁড়িপাতিল নিয়ে সবাই বেশ বড় সংসার পেতেছেন। রোগী নেই বলে দুইটি শয্যাকে একসঙ্গে করে রোগী ও তাঁর স্বজনরা থাকছেন।


কয়েকটি কেবিন তালাবদ্ধ। কয়েকটি কেবিন ব্যবহারের অযোগ্য। সাধারণ ওয়ার্ডে থাকা রোগীদের অভিযোগ, বেশি টাকা না দিলে কেবিন খালি থাকলেও তাতে ভর্তি করা হয় না।


মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ডের অব্যবস্থাপনার বিষয়টি স্বীকার করলেন ওয়ার্ডের ইনচার্জ মঞ্জু আরা বেগম। তিনি ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ওয়ার্ডে যাঁরা মারাত্মক যক্ষ্মা (এমডিআর টিবি) বা অন্য কোনো রোগে অসুস্থ, তাঁদেরই চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। ওয়ার্ডে কর্মরতদের মধ্যে তিনিই একমাত্র ‘সুস্থ’ বলে দাবি করেন। তিনি জানালেন, অনেকবার ঝাড়ুদারসহ অন্যান্য জনবল চাওয়া হলেও কর্তৃপক্ষ তা দেয়নি। তবে রোগীদের মাধ্যমে টাকাপয়সা লেনদেনের সঙ্গে তিনি কোনোভাবেই জড়িত নন বলে জানালেন।

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহেদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই হাসপাতালের এ ওয়ার্ডে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সরকার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের যতটুকু সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা, তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে ১৯৫৫ সালে নির্মিত হাসপাতাল ভবনটি সব সময় পরিষ্কার রাখা সম্ভব হয় না। জনবলের স্বল্পতাও আছে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি থাকেন মাত্র কয়েকজন, পুরোটা খালিই থাকে। কিন্তু এ সময় অন্য সাধারণ রোগীদের ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে অন্য রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছে।

পরিচালক জানালেন, এক বছরের মধ্যেই হাসপাতাল ভবন ভেঙে নতুন ভবন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হবে। তখন আর আলাদা করে মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ড থাকবে না। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা পুরো হাসপাতালেই তাঁদের প্রাপ্য সেবা ও সম্মান পাবেন।
মুক্তিযোদ্ধা রোগীদের কেউ কেউ কেবিন দখলসহ বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহেদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও এ ধরনের অভিযোগের কথা শুনি। কিন্তু কেউ সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করেন না, ফলে সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’