অন্য রকম এক মায়ের গল্প

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার হাতিরবাগান মাঠে শিশুটির জন্ম হয়। শিশুটির মা মানসিক ভারসাম্যহীন সালমা এখন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার হাতিরবাগান মাঠে শিশুটির জন্ম হয়। শিশুটির মা মানসিক ভারসাম্যহীন সালমা এখন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

সালমা এই হাসেন তো এই কাঁদেন। কখনোবা লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলছেন। কখনো খালি পায়েই হেঁটে বেড়াচ্ছেন হাসপাতালের এক মাথা থেকে আরেক মাথায়। যেন হাসপাতালের দমবন্ধকর পরিবেশ থেকে মুক্তি চান।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে সালমাকে এখন অনেকেই চেনেন। মাদারীপুরের শিবচরের ‘পাগলি মা’ হিসেবে পরিচিত পেয়েছেন তিনি। গত ২২ ফেব্রুয়ারি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন সালমা একটি মাঠে সন্তানের জন্ম দেন। এলাকার কয়েকজন তরুণ মাকে সাহায্য করেন। নবজাতকটির দায়িত্ব নেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দম্পতি।

সালমা ৩ মার্চ থেকে রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসক খসরু পারভেজ চৌধুরীর অধীনে রয়েছেন। এই মায়ের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন যমুনা ব্যাংক লিমিটেডের ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শামীম আহমেদ ও তাঁর বন্ধুরা। ঢাকা থেকে শিবচর গিয়ে স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে সালমাকে ঢাকায় এনেছেন শামীম আহমেদ।

কাগজে-কলমে শামীম আহমেদ এখন সালমার অভিভাবক। ঢাকায় সালমাকে আনার পর দুই দিন নিজের বাসায় রেখেছিলেন। এই কাজে তাঁর পাশে থেকেছেন স্ত্রী স্কুলশিক্ষিকা আফরিন জাহান এবং দুই সন্তান।

শামীম আহমেদ অবশ্য এই কাজ নতুন করছেন না। ২০১৫ সাল থেকে আশ্রয়হীন, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো মানসিক ভারসাম্যহীন পাঁচজন নারীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। তাঁদের বাসায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। এখনো তাঁদের ওষুধের বন্দোবস্ত করছেন।

গত শনিবার বিকেলে হাসপাতালে সালমার সঙ্গে কথা হয়। বেশির ভাগই অসংলগ্ন। হাসপাতালের দায়িত্বরত নার্স ও অন্য রোগীর স্বজনেরা জানালেন, আগের তুলনায় সালমা এখন অনেক সুস্থ। পরনের সালোয়ার-কামিজও পরিষ্কার। বেশ পরিপাটি। হাসপাতালে সালমার দেখভাল করছেন ব্যাংকার শামীম আহমেদের বেতনভুক্ত সেবিকা জরিনা বেগম। তাঁর মুখেও পরিতৃপ্তির হাসি।

সালমা এখন নিজের সম্পর্কে কিছু কিছু কথা বলতে পারেন। বাবা ও বাড়ির ঠিকানা বলতে পারেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার তালশহর গ্রামে সালমার জন্ম। বাবার নাম নবী হোসেন। মা মারা গেছেন।

তবে সালমার ভাষ্য, বাবা ও ভাইয়েরা তাঁকে মারধর করতেন। সালমার বিয়ে হয়েছিল। গানবাজনা পছন্দ করতেন। স্বামীর সঙ্গে সংসার করা হয়নি। সে সংসারে আরেকটি মেয়ে ছিল। তারপর কথার খেই হারিয়ে ফেলেন সালমা। ওই সংসার, মেয়ে কোথায় আছে, তিনি শিবচরে কীভাবে গেলেন—এর হদিস মেলে না। তবে শিবচরে বিভিন্ন বয়সী পুরুষ তাঁর কাপড় নিয়ে টানাটানি করতেন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছু করতেন, মনে করতে পারেন এখনো। বালুর মাঠে সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময়ের কষ্টের কথাও মনে আছে।

একটু পরই হেসে বলেন, ‘আমি আমার মেয়েরে মারমু।’ আবার নাড়িছেঁড়া ওই ধনের জন্যই কাঁদেন।

শামীম আহমেদ জানালেন, সালমা বাড়ির ঠিকানা ঠিকই জানিয়েছেন। ফেসবুকের বন্ধুদের সহায়তায় বিভিন্নভাবে সালমার এক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তবে আর্থিক অবস্থা খারাপ জানিয়ে তিনি সালমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে চাননি।

হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে সালমাকে রাখা হবে সেবিকা জরিনা বেগমের জিম্মায়। তারপর তাঁর জন্য একটি কাজের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে শামীমের।

হাসপাতালে দেখা গেল, শামীম আহমেদের সঙ্গে সালমার বেশ সখ্য গড়ে উঠেছে। সালমা তাঁকে ভাই ডাকেন। কথার এক ফাঁকে আবদার করলেন, ‘ভাই, আমার মেয়ের ছবিডা একটু দেহাও (দেখাও) না।’ শামীম আহমেদ মুঠোফোনে ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা ফুটফুটে কন্যাসন্তানের ছবি বের করে দেখালেন। এ সময় সালমার চোখেমুখে খুশির আভা। বললেন, ‘এই ছোড পুতুলডাই তো আমার মেয়ে।’

এলাকার তরুণ মো. জাহিদ হাসান ও তাঁর বন্ধুরা সন্তান জন্মের পর সালমার নাড়িকাটা, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করার কাজে সহযোগিতা করেন। তাঁরাই নবজাতকের নাম রাখেন জান্নাতুল হাবিবা নূরে হুমাইরা। সালমা মেয়ের পুরো নামও মনে রেখেছেন। তবে এই মেয়ে এখন কোথায় আছে, এই মেয়ের বাবা কে, মেয়েকে দেখতে চান কি না ইত্যাদি প্রশ্নে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন এই মা। কেননা, এই কঠিন প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা নেই তাঁর।

জাহিদ হাসান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ২২ ফেব্রুয়ারি, রাত নয়টা বা সাড়ে নয়টা বাজে। এলাকার বালুর মাঠটির কাছে বসেই তাঁরা আড্ডা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ নবজাতকের কান্নার শব্দ শুনে তাঁরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। তারপর কাছে গিয়ে দেখেন, বালুর মধ্যে মায়ের নাড়ির সঙ্গে লাগানো একটি নবজাতক। আশপাশের কয়েকজন নারীকে ডাকা হলেও তাঁরা অপারগতা প্রকাশ করেন।

জাহিদ হাসান বলেন, ‘মোটরসাইকেল দিয়ে আমার পারিবারিক চিকিৎসককে নিয়ে আসি। তারপর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করি। এই মা সুস্থ থাকলে মেয়েকে নিজের কাছেই রাখতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি নন। তাই নবজাতকটির দায়িত্ব নিয়েছেন এক দম্পতি। এখন এই মা যাতে সুস্থ হোন, সেই দোয়া করি।’