সাব্বির অবশেষে বিতর্ক নিয়ে মুখ খুললেন

>

ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলতে পারেননি, খেলতে পারছেন না বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগও (বিসিএল)। সাব্বির রহমান ঘরোয়া ক্রিকেটে ছয় মাস নিষিদ্ধ। গত ডিসেম্বরে রাজশাহীতে জাতীয় লিগের শেষ রাউন্ডের ম্যাচে খেলা চলার সময় কিশোর দর্শককে মারধর করে তুমুল সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। নানা বিতর্ক আর মাঠে ছন্দ হারিয়ে ফেলা সাব্বির একরকম গুটিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন রানা আব্বাসের কাছে

বিতর্ক পেছনে ফেলে সাব্বির রহমানের চোখ এখন সামনে। ছবি: প্রথম আলো
বিতর্ক পেছনে ফেলে সাব্বির রহমানের চোখ এখন সামনে। ছবি: প্রথম আলো

শুরুতে জানতে চাই, সাব্বির রহমানের ক্রিকেট-জীবন কেমন কাটছে?
সাব্বির: নিদাহাস ট্রফির পর লম্বা একটা ছুটি গেছে। আগামী মাসের ১৩ তারিখ থেকে জাতীয় দলের ক্যাম্প শুরু হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনুশীলন করছি, ফিটনেস নিয়ে কাজ করছি। মাঝে আমার আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম। নতুন বাসায় উঠেছি (মোহাম্মদপুরে), সেটাও গুছিয়ে নিয়েছি। লম্বা ছুটি গেছে, এটা দরকার ছিল আমার। সময় কখনো ভালো গেছে, খারাপও গেছে। দুঃসময়-সুসময় মিলিয়েই সময়টা কেটেছে। এর মধ্যে রাজশাহীতে ছিলাম ১০-১২ দিনের মতো।

আপনার যখন অখণ্ড অবসর, সতীর্থেরা ব্যস্ত প্রিমিয়ার লিগ, বিসিএল নিয়ে। আপনি ম্যাচ খেলতে পারছেন না, একজন পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে এটি কতটা কষ্টের?
সাব্বির: একজন পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে সব সময়ই মাঠে থাকতে পছন্দ করি। অনুশীলন-ম্যাচে থাকতে চাই সব সময়ই। সেটি যে ধরনের ম্যাচই হোক না কেন। অনেক মিস করেছি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ আর বিসিএল। প্রতিবছরই এই লিগগুলো খেলে থাকি। আমার কাছে অনেকে জানতে চেয়েছে, কেন খেলতে পারছি না। তাদের বলতে পারছি না আমি নিষিদ্ধ!

এটা কতটা অস্বস্তিকর কিংবা বিব্রতকর অভিজ্ঞতা আপনার জন্য?
সাব্বির: বিব্রতকরই বলতে পারেন। আমি বলতে পারছি না নিষেধাজ্ঞার কথাটা। কিন্তু সত্য কথাটা বলা উচিত। একটা ভুল হয়ে গেছে। জীবনে এটা ঘটতেই পারে। আমি মনে করি, আমার একটা দুঃসময় গেছে। নিষেধাজ্ঞা প্রায় শেষের দিকে। মাস খানেক পরেই ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। পরের টুর্নামেন্ট বা লিগে আবারও খেলব আশা করি।

ভুল হয়ে গেছে বলছিলেন। ভুলটা কীভাবে হয়েছে বলা যায়?
সাব্বির: এক হাতে তালি বাজে না! যে ছেলেকে মেরেছি বলে শোনা গেছে, সে আমার অপরিচিত নয়। আমার বাড়ির পাশেই থাকে। দরিদ্র পরিবারের ছেলে। নানাভাবে তাকে আমি সহায়তা করি। পড়াশোনা যাতে করতে পারে বা ঈদের সময় আর্থিক সহায়তা করি। জামাকাপড় থেকে শুরু করে নানাভাবে সহায়তা করি। আমার সঙ্গে অনুশীলনও করেছে অনেক সময়।

ছেলেটা আপনার পরিচিত বলছেন। সে কি আপনাকে বিরক্ত করেছিল? জানতে চাচ্ছিলাম কীভাবে ঘটেছে ঘটনাটা?
সাব্বির: হ্যাঁ, পরিচিত। সে বিরক্ত করেনি, বিরক্ত করেছিল দর্শকেরা। এটা নিয়ে বিস্তারিত বলতে চাইছি না। হুট করে তো একজনকে মারধর করা যায় না। ইয়ার্কি-ফাজলামো করে হয়তো দু-একটা চড়-থাপ্পড় মারা যায়। এটাই হয়েছে। কিন্তু সবাই তো অনেক গুরুতরভাবে নিয়েছে বিষয়টা। আমার পরিচিত, তাকে ও তার পরিবারকে অনেক সহায়তা করি। যেভাবে ঘটনাটা ছড়িয়েছে, এটা পুরোপুরি সত্য না-ও হতে পারে, তিলকে তাল করা হতে পারে। ঘটনার সময়ে আমার সতীর্থরা, কাছের বন্ধুরাও ছিল। সবার কাছে যাচাই-বাছাই না করে এভাবে একজনের বিরুদ্ধে খবর ছড়ানো...।

যেটি ঘটেছে, সেটি পুরোপুরি সত্য নয় তাহলে?
সাব্বির: সবার সামনে একজনের গায়ে হাত তুলেছি, এটা হয়তো চোখে পড়েছে অনেকের। এভাবে মারধর করাটা বড় ভুল হয়েছে। বুঝতে পারছি, ইয়ার্কি-ফাজলামো করেও কাউকে মারা ঠিক না। পরে বুঝতে পেরেছি, অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। এই ভুল দ্বিতীয়বার হবে না। ওই সময়ে ঘটনার আকস্মিকতায় ঘটে গেছে। এ ঘটনা নিয়ে আমি দুঃখিত।

নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে অবশেষে রানের দেখা পেয়েছেন সাব্বির। ছবি: প্রথম আলো
নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে অবশেষে রানের দেখা পেয়েছেন সাব্বির। ছবি: প্রথম আলো


২২ গজেও দুর্দান্ত সাব্বিরকে দেখা যাচ্ছে না অনেক দিন হলো। নিদাহাস ট্রফিতে বাংলাদেশের প্রায় প্রতি ম্যাচের আগেই শোনা যেত, এই ম্যাচে সাব্বির বাদ! মানসিকভাবে শক্ত থাকাটা কতটা কঠিন ছিল তখন?
সাব্বির: বাদ পড়ার বিষয়টা আমার কানে আসেনি। এগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই হয়তো বেশি আলোচনা হয়েছে। আমার সতীর্থ বা টিম ম্যানেজমেন্টের মধ্যে এমন আলোচনা শুনিনি। এখন তো টিম ম্যানেজমেন্ট দল দেওয়ার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাদশ দেখা যায়! সবাই নিজেদের মতো একাদশ জানিয়ে দেয় ফেসবুকে। তবে গত ছয় মাস অনেক মানসিক চাপে ছিলাম। এত চাপ, এত ঘটনার পরও কঠোর অনুশীলন করেছি, রানে ফিরতে চেয়েছি। চেয়েছি ভালো কিছু করতে। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছিল না।

আপনার জীবনে এতটা কঠিন সময় আগে কখনো এসেছে?
সাব্বির: গত ছয় মাস যেভাবে গেছে জীবনে এত কঠিন সময় আগে আসেনি। চারদিক থেকে এত চাপ, এত মানসিক চাপ নিয়ে একজন খেলোয়াড়ের স্বাভাবিক খেলাটা খেলা খুব কঠিন। আমাকে রান করতেই হবে, এটা ভেবে নিজের ভেতরই বেশি চাপ নিয়ে ফেলেছিলাম। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মানসিকভাবে অনেক শক্ত। এ সময়ে নিজের কাজটা ঠিকঠাক করার চেষ্টা করেছি। দলের সিনিয়র খেলোয়াড়, টিম ম্যানেজমেন্ট ও কোচিং স্টাফ সবাই আমাকে অনেক সহায়তা করেছে। এটাই অবশেষে ছন্দ ফিরে পেতে সহায়তা করেছে। এত দীর্ঘ সময় খারাপ আগে কখনো যায়নি। তবে চেষ্টা করেছি এটা কাটিয়ে উঠতে।

টানা ব্যর্থতার পর কলম্বোয় ভারতের বিপক্ষে নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে একটা দারুণ ইনিংস আপনার ব্যাটে দেখা গেছে। ফাইনালে দল হারলেও ৭৭ রান আপনাকে ছন্দ ফিরে পেতে কতটা আত্মবিশ্বাসী করেছে?
সাব্বির: যেটা বললাম, কোচিং স্টাফ, টিম ম্যানেজমেন্ট আমাকে পুরো সিরিজে অনেক সহায়তা করেছে। খারাপ করলে বলেছে, এই ম্যাচে হয়নি, পরের ম্যাচে হবে। বারবার বলেছে, তুই পারবি ফিরতে। এভাবে আমাকে সাহস জুগিয়েছে সবাই। সামনাসামনি বলতে পারিনি, এখানে তাদের ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ আমার ভক্ত-সমর্থকদেরও। দুঃসময়ে তাদের অনেকেই আমার পাশে ছিল।

চুক্তি থেকে বাদ পড়েছেন। যদিও এটা আপনার জন্য খবরটা নতুন নয়। জানুয়ারিতেই বিসিবি জানিয়ে দিয়েছিল, শাস্তি হিসেবে আপনাকে নতুন চুক্তিতে রাখা হবে না।
সাব্বির: এটা নিয়ে কিছু ভাবছি না। বিসিবি আমার অভিভাবক প্রতিষ্ঠান, তারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমার ভালোর জন্য হয়তো নিয়েছে। আমি একটা ঘটনা ঘটিয়েছি, সে কারণে হয়তো চুক্তি থেকে বাদ দিয়েছে। ভবিষ্যতে নিজের জীবন নিয়ে আরও সচেতন থাকব, সংযত থাকব সবকিছু নিয়েই। সতর্ক থাকব আমাকে নিয়ে যেন বিসিবি বিব্রত না হয় বা ভবিষ্যতে আমার পরিবার বা আমি বিপদে পড়ি।

ভুলের কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ঘটনা থেকে আপনি কী শিক্ষা নিচ্ছেন?
সাব্বির: প্রত্যেক মানুষই ভুল করে। ভুল হয় বলেই সেটি সে সংশোধন করে। আমি একটা ভুল করেছি। সেই ভুলের সংশোধন করছি ধীরে ধীরে। নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিচ্ছি। আশা করি, এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।

সামনে আফগানিস্তান সিরিজ। সিরিজটা হবে টি-টোয়েন্টিতে। এই সংস্করণ তো আপনার ভীষণ প্রিয়! দুঃসময় পেছনে ফেলে এই সিরিজে নিজেকে কীভাবে তৈরি করছেন?
সাব্বির: টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলতে হয় আক্রমণাত্মক মেজাজে। খেলতে হয় ইতিবাচক মানসিকতায়। সামনে যে সিরিজটা আসছে, এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই সিরিজ দিয়ে অনেক দিন পর আমরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরছি। ওদের ভালো কিছু বোলার আছে। নিজের দুর্বলতা নিয়ে গত দুই-তিন মাস কাজ করছি। সামনে সিরিজের আগে পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাব।

তবে কি এবার নতুন সাব্বিরকে দেখা যাবে? তাঁর পেছন থেকে সরে যাবে বিতর্কের ছায়া?
সাব্বির: জাতীয় দলের খেলোয়াড় হিসেবে অনেক ভক্ত-সমর্থককে কষ্ট দিয়েছি। যদিও এসব ইচ্ছাকৃত নয়। ভুলবশত হয়ে গেছে। আমি সবার কাছে ক্ষমা চাইছি। নিজেকে ঠিক করে ফেলব আশা করি। আর বিতর্কের বিষয়টা হচ্ছে, এটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই বেশি হয়। অনেক সময় দেখা যায় কিছুই করিনি, অথচ একটা খবর ছড়িয়ে পড়েছে! আমার কাছে মনে হয়, একটা খবর ছড়ানোর আগে সেটি ভালো করে যাচাই-বাছাই করা উচিত।