ভালোবাসা দিয়ে তাদের ফেরাতে হবে

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সহকারী উপকমিশনার আবদুল মান্নান বলেছেন, উগ্রবাদ বাংলাদেশের জন্য বড় ঝুঁকি। কারণ, উগ্রবাদ থেকে ব্যক্তি পরবর্তী সময়ে সহিংস চরমপন্থা এবং সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ে। তাই কেউ উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়লে তার প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ নয়, ভালোবাসা দিয়ে তাকে বিপথ থেকে ফেরাতে হবে।

গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর কার্যালয়ে ‘শান্তি ও সহিষ্ণুতা: প্রতিবন্ধকতা এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনার সময় আবদুল মান্নান এ কথা বলেন।

আবদুল মান্নান বলেন, দুই-চার বা দশজনের জঙ্গি হামলা বাংলাদেশের মতো ১৭ কোটি মানুষের দেশে বড় কোনো সমস্যা না। মূল ঝুঁকিটা হচ্ছে উগ্রবাদের। সব ধর্মেই মৌলবাদ রয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে ইসলামি মৌলবাদ বাংলাদেশের জন্য বড় হুমকি। তাঁর মতে, ধর্মবিশ্বাসের জায়গাটা যখন সহিংস হয়ে অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে যায় তখন তা উদ্বেগের বিষয়।

আবদুল মান্নানের মতে, নতুন প্রজন্ম বাঙালির দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সহিষ্ণুতার প্রতি শ্রদ্ধা ও মূল্যবোধ নিয়ে বড় হতে পারছে না। এ অবস্থায় নৈতিক শিক্ষা পরিবার থেকে হতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধের ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে। সন্তানের আইকনিক চরিত্র হতে হবে মা-বাবাকে। আবদুল মান্নান বলেন, তরুণ প্রজন্মকে সঠিক পথে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে, দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ পারে একটি সহিষ্ণু প্রজন্ম গড়ে তুলতে।

হোলি আর্টিজান হামলার বার্ষিকীতে একমাত্র প্রতিবাদকারী ফারাজ আইয়াজ হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানান আবদুল মান্নান।

বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। বৈঠকের শুরুতে তিনি আগামী ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার বার্ষিকী সামনে রেখে শান্তি ও সহিষ্ণুতার বিষয়ে আলোচনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।

রাষ্ট্রপক্ষের সাবেক কৌঁসুলি (পিপি) মো. কবির হোসাইন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মতো আলোচিত মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অপরাধীদের প্রশ্ন করা হলে তাদের স্পষ্ট জবাব ছিল, হামলা করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে তাই করেছি।’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী বলেন, নতুন প্রজন্ম কিন্তু জ্ঞান পছন্দ করে না। শুধু জিপিএ-৫ পেতে চায়। এটা কিন্তু বড় ধরনের সাংস্কৃতিক দূরত্ব তৈরি করছে। এ জন্য আগামী ১০ থেকে ২০ বছর পর জাতিকে একটা অনিবার্য পরিণতি ভোগ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে তথ্যভান্ডার উন্মুক্ত। বিভ্রান্ত তথ্য দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকি আছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে সঠিক তথ্যের প্রচার ও প্রসারে শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গণমাধ্যমকে বড় ভূমিকা নিতে হবে।

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী ধ্রুবেশানান্দ বলেন, ‘সে-ই প্রকৃত ধার্মিক যে প্রত্যেক ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখে। আমাদের স্কুলের শিক্ষা হলো, মানুষ গড়ার শিক্ষা। মানুষ তখনই হয় যখন শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধার্মিক উন্নতি হবে। প্রত্যেকের প্রত্যেক ধর্মের প্রতি সম্মান থাকতে হবে। অন্য ধর্মের সমালোচনা করতে চাইলে, তার আগে সেই ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে।’

বেসরকারি সংস্থা প্রাগ্রসরের নির্বাহী পরিচালক ফওজিয়া খন্দকার বলেন, ‘বাইরে আমরা বৈচিত্র্যের কথা যেভাবে প্রচার করি, পরিবারের ভেতর তা জানাই না। সন্তানের সঙ্গে বাবা-মার বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়ে ভিন্ন মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। ফলে পরিবার থেকে অসহিষ্ণুতার শুরু। তাই সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ার কাজটা শুরু করতে হবে বাড়ি থেকে।’

কমিউনিটি রেডিও হেকাথনের প্রধান সঞ্চালক মো. রিয়াজ উদ্দিন খান বলেন, শান্তি ও সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে কমিউনিটি রেডিও।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি সমন্বয়ক আবদুল্লা আল মামুন বলেন, ‘সম্প্রীতির যে প্রতিপাদ্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার চিত্রটা উজ্জ্বল নয়। তরুণদের মাঝে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। এটা আমাদের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ।’

কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, ‘কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে বলতে হয়, সহিষ্ণুতা আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। তাই শত শত বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয়গুলো অরক্ষিত আছে। আমরা একে অন্যের সঙ্গে সহাবস্থান করছি। আমাদের তরুণ প্রজন্ম যখন নিজের পেশাগত জীবন নিয়ে এত অগ্রসর ভাবনা করছে, একই সময়ে কেন জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়, তা নিয়েও ভাবার আছে।’

ইউএন উইমেনের মনিটরিং অ্যান্ড রিপোর্টিং অ্যানালিস্ট আসমা আফরিন হক বলেন, গত বছর তাঁর সংস্থা যে কর্মসূচি শুরু করেছে তার লক্ষ্য হচ্ছে জঙ্গিবাদে পুরুষের প্রভাবে নারীদের জড়িয়ে পড়া রোধ করার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা।

কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মীর মনজুর মাহমুদ বলেন, ‘ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি শান্তি ও সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে নিজেদের সামর্থ্য বাড়িয়ে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ আছে।’

গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির প্রকল্প সহযোগী সিদ্ধার্থ গোস্বামী, প্রেরণার প্রকল্প সমন্বয়ক উম্মে হাবিবা, ফিল্ম ফর ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পারভেজ সিদ্দিকী ও ফানুসের পরিচালক (পরিচালনা) সাজ্জাদ হোসেন। তাঁরা সবাই শান্তি ও সহিষ্ণুতার বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।