মায়ের প্রেরণায় এমন অর্জন

চট্টগ্রাম শহরের খুলশী এলাকার রেলক্রসিং পার হয়ে কিছুদূর সামনে এগোতেই উত্তরে মুখ করে থাকা ছোট্ট একটা গলি। সেই গলির মুখে দাঁড়িয়ে আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরীর নামটা পুরো মুখে আনতে হলো না। নামটা বলা শুরু করতেই আশপাশের মানুষ দেখিয়ে দিলেন তার বাড়ি। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও) বাংলাদেশের হয়ে প্রথম সোনা নিয়ে আসা তরুণের বাড়িটাই যেন এখন এলাকার সবার আবেগের স্থান।

গতকাল শুক্রবার দুপুরে আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে পাওয়া গেল বাবা আহমেদ আবু জোনায়েদ চৌধুরী ও মা সৈয়দা ফারজানা খানমকে। সাজানো-গোছানো ড্রয়িংরুম।

পাঁচ তাকের আলমারিতে পরপর রাখা নানান পুরস্কার, স্মারক-এই সবকিছুর ‘মালিক’ আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী। ছেলের সেসব অর্জনের পাশে বসে সুখী মা-বাবা খুলে দিলেন স্মৃতির ঝাঁপি। সেসব স্মৃতি বলতে গিয়ে কখনো আবেগে গলা ধরে এল, কখনো চোখের কোণে চিক চিক করে ওঠে দুজনের। তার মাঝে যা বললেন-তার পুরোটাই যেন ছেলের গৌরবগাথা।

হাসিখুশি বাবা–মা। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে সোনাজয়ী ছেলে আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরীকে ফোন দিচ্ছেন বাবা ও মা। পেছনে জাওয়াদের ছোট বোন। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের খুলশী গ্রিন সোসাইটি এলাকার বাড়িতে।  ছবি: সৌরভ দাশ
হাসিখুশি বাবা–মা। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে সোনাজয়ী ছেলে আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরীকে ফোন দিচ্ছেন বাবা ও মা। পেছনে জাওয়াদের ছোট বোন। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের খুলশী গ্রিন সোসাইটি এলাকার বাড়িতে। ছবি: সৌরভ দাশ

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রোমানিয়ার ৫৯ তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী দেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক জয় করল, মা সৈয়দা ফারজানা খানম নিজেকে ‘হালকা’ করতে তখন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অন্যদিকে বাবা আহমেদ আবু জোনায়েদ চৌধুরী ব্যস্ত তাঁর কার্যালয়ে। ফারজানা খানমের কাছেই প্রথমে এল খবরটা। তিনি বলেন, ‘প্রথম আলো থেকে ফোনে প্রথমে জানানো হয় আমাকে। এরপর আনন্দে কেঁদে ফেলি। এখন আমরা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মা-বাবা।’ এরপর থেকে আত্মীয়স্বজনের ফোন ধরেই সময় কাটছে মা-বাবার।

আহমেদ জাওয়াদের গণিতের প্রতি ভালো লাগা শুরু হয়েছিল সেই ২০০৯ সালে। সে তখন সবে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। সে সময় তার মা ফারজানা খানম ছেলেকে ব্রেন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ইউসিমাস-এ ভর্তি করিয়ে দেন। পাশাপাশি ছেলেকে কিনে দেন গণিতসংক্রান্ত বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বইও। মায়ের সেই উৎসাহ থেকেই শুরু। পরে যখন সে পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষা শেষ করে তখন তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ফারজানা খানমকে পরামর্শ দেন জাওয়াদকে আঞ্চলিক গণিত অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় পাঠানোর। সেবারই প্রাথমিক ক্যাটাগরিতে সারা দেশের মধ্যে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন’ হয় জাওয়াদ। আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পরের আটটি প্রতিযোগিতাতেই কোনো না কোনো পদক নিয়ে এসেছে সে। আর আইএমওতে ২০১৬ সালে ব্রোঞ্জ ও ২০১৭ সালে রৌপ্যপদক পেয়েছিল সে। এবার ছাড়িয়ে গেল সব অর্জনই।

আহমেদ জাওয়াদ
আহমেদ জাওয়াদ

চট্টগ্রামের ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে জাওয়াদ। কয়েক দিন পরেই ফল বেরোবে। কিন্তু ছেলের আসন্ন ফল নিয়ে বাবা-মা দুজনই চাপমুক্ত। তাঁদের কথা, ‘জিপিএ-৫ পাওয়ার দৌড়ে আমরা ছেলেকে রাখিনি। এসএসসি পরীক্ষায় ওর সব বিষয়ে জিপিএ-৫ আসেনি। কিন্তু আমরা এ নিয়ে একেবারেই মন খারাপ করিনি। কারণ আমরা ছেলেকে তার মতো বড় হতে বলেছি। সে নানা বই পড়ার মধ্যে দিয়েই আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে, নিজেকে গড়ে তুলছে। এতেই আমরা খুশি।’

ছেলেকে নিয়ে এবার আরও বড় স্বপ্ন দেখছেন বাবা-মা। তাঁদের চাওয়া, এইচএসসির পর ছেলে বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নেবে। তবে তাঁদের শেষ চাওয়া একটাই-পড়াশোনা শেষে জাওয়াদ দেশে ফিরে আসবে। তারপর দেশের জন্য কাজ করবে। মা ফারজানা জানালেন, জাওয়াদের অবসর কাটে বই পড়ে। তবে প্রতি শুক্রবারে তার একটাই শিডিউল। চিটাগং ম্যাথ ক্লাবে নানা বয়সের শিক্ষার্থীদের গণিত প্রশিক্ষণ দেওয়া।