মা, তুমি আগাইয়া যাও


‘মেয়েটাকে যখন টেলিভিশনে দ্যাখলাম, জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সংগীতের সঙ্গে স্যালুট দিচ্ছে আর কানতাছে...। মনটা আর মানল না। আমরাও সবাই কাইন্দা ফেললাম। আশপাশে যারাই ছিল কানছে। যতবারই ওই ভিডিওটা দেখছি, ততবারই কাইন্দা ফালাইছি...।’ আবেগাপ্লুত হয়ে এই কথাগুলো বলছিলেন মাবিয়া আক্তারের মা আক্তার বানু। মায়ের কান্না সংক্রমিত হয় বাবা হারুনর রশিদের চোখও।

এসএ গেমসের তৃতীয় দিনে ভারোত্তোলনে প্রথম সোনার পদক জেতে বাংলাদেশ। গুয়াহাটির ভোজেশ্বরী ফুগনোনি ইনডোর স্টেডিয়ামে ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে দেশকে এই সাফল্য এনে দেন মাবিয়া আক্তার (সীমান্ত)। সোনা জেতার পর মাবিয়ার জাতীয় সংগীতের সঙ্গে স্যালুট আর আবেগাপ্লুত কান্নার ভিডিও সবার মন ছুঁয়ে গেছে।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের সিপাহিবাগের নতুন রাস্তার পাশে নবীনবাগে মাবিয়াদের বাড়িতে গতকাল বুধবার দুপুরে কথা হয় তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে। মাবিয়ার কথা জানতে চাইতেই বাবা ফিরে গেলেন পুরোনো দিনে। সেই ২০০১ সালের কথা। ছোট্ট মাবিয়াকে নিয়ে তাঁরা খিলগাঁও চৌরাস্তা থেকে এই এলাকায় আসেন। তিন-চার বছর বয়স মাবিয়ার। ডোবার ওপর টিনের ঘর। সাঁকো পার হয়ে ঢুকতে হয় বাড়িতে। আশপাশে খেলার জায়গা তেমন নেই। রাস্তার আশপাশে গিয়ে খেলাধুলা করতেই বেশি ভালোবাসতেন মাবিয়া।
হারুনর রশিদ বলছিলেন, ‘ছোট্ট থাইকাই খেলাধুলায় আগ্রহ ছিল। মাবিয়া তখন সেভেন পাস কইরা এইটে উঠছে, পড়ালেখা ফাঁকি দেওয়ার এত নেশা ছিল যে খেলা পাইলেই অইছে...। এই নিয়া একদিন আমি বকাঝকা করলাম।’

মাবিয়ার বাবা ও মা। পেছন থেকে যারা সব সময় সাহস জুগিয়েছেন।
মাবিয়ার বাবা ও মা। পেছন থেকে যারা সব সময় সাহস জুগিয়েছেন।

মাবিয়ার মামা জাতীয় দলের বক্সার কাজী শাহাদাৎ হোসেন ভাগনির কান্না দেখে এর কারণ জানতে চাইলেন। পরে ভাগনির খেলাধুলার প্রতি আগ্রহের কথা জেনে পরদিনই তাঁর সঙ্গে নিয়ে গেলেন বড় স্কুলে ভর্তি করাবেন বলে। মাবিয়ার বাবার ভাষায়, ‘আমি এত জানি না, সারা দিন শেষে সইন্ধার সময় নিয়া আইছে। এ রকম তিন-চার দিন নেওয়ার পর ওর ওইখানে মাইয়ার ভালো লাইগা যায়।’ এভাবেই খেলাধুলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে মাবিয়া। সিপাহিবাগ যুব সংহতি ক্লাব থেকেই জীবনে প্রথম খেলার পুরস্কার পায় মাবিয়া।
মেয়ে খেলাধুলা করে—এ নিয়ে প্রতিবেশীদের বাঁকা চোখকে কখনো তোয়াক্কা করেননি মা আক্তার বানু। মেয়ের পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন। প্রতিবেশীদের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার শখ আছিল মেয়ে খেলা করুক। আমারে জিগাইছে সবাই, কী করে মেয়ে? আমি বলছি ভারোত্তোলন খেলে মতিঝিলে। ভারোত্তোলন কী, মানুষ জানত না? এটা-ওটা বলত। আমি মেয়েরে কইতাম, দেখো মা, তোমারে কে কী কইল না কইল কোনো কথা কানে নিয়ো না। আমি ঠিক, জগৎ ঠিক, আগাইয়া যাও। তোমার পাছে আমি আছি, তোমার মামা আছে, তুমি কোনো কথা কানে নিয়ো না।’
শুরুতে মামা কাজী শাহাদাৎ তাঁর ভাগনিকে বক্সিং শেখালেও পরে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। সে কথা নিজেই জানালেন শাহাদাৎ। তিনি বলেন, ‘বক্সিং বেশ ব্যয়বহুল খেলা। এটা দিয়েই শুরু হয়েছিল মাবিয়ার কার্যক্রম। কিন্তু পরে তাকে ভারোত্তোলনের দিকেই ঠেলে দেওয়া হলো। আর এটাতেই বাজিমাত করল আমার ভাগনি। একের পর এক পুরস্কার ছিনিয়ে আনতে থাকল। মোট ১৩ দেশে গেছে সে। সর্বশেষ এসএ গেমসে সোনা জিতল।’ এই সাফল্যের পেছনে কাজল দত্ত, ফারুক সরকার, শুচি ও আনসার বাহিনী এবং ফেডারেশন কর্মকর্তাদের কথাও বারবার উল্লেখ করলেন তিনি।

মামা, মাবিয়ার মাবিয়া হয়ে ওঠার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি।
মামা, মাবিয়ার মাবিয়া হয়ে ওঠার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি।

নিজের স্বপ্নের ফুল ফুটিয়েছে ভাগনি, সে কথাও জানালেন মামা। বললেন, ‘আমি মাবিয়ার খেলা দেখে খুবই আশাবাদী ছিলাম, সে সোনা জিতবেই। আমার স্বপ্ন পূরণ করে দিল আমার ভাগনি। মাবিয়ার মা-বাবাও মেয়ের সাফল্যের সবচেয়ে বড় দাবিদার হিসেবে বারবারই বললেন মামা শাহাদাৎ হোসেনের কথা। পাশাপাশি মেয়ের তুমুল আগ্রহের কথাও বলতে ভুললেন না।
মাবিয়ারা দুই বোন আর এক ভাই। বাবার একটা ছোট্ট মুদি দোকান। আর মা বাড়িতেই কাজ করেন। মাবিয়ার বড় বোন এসএসসি পাস করেছে। আর ভাই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে।
মাবিয়ার সোনা জয়ের খবরও তাঁর বাবা-মাকে দিয়েছেন শাহাদাৎ। মাবিয়ার বাবা বলছিলেন, ‘খবর শুনেই টেলিভিশনে দেখি মেয়ের নাম দেখাইতেছে। সত্যিকারে আমি কাঁদছি। আমাদের বাড়িতে ওর মাসহ সবাই কাঁদছি। পুরা জাতীয় সংগীত বাজছে আমরা, আমাদের প্রতিবেশীরা কাঁদছে। এমন কোনো লোক নাই গরিব থেকে শুরু করে বস্তিবাসী সবাই জড়ায় ধরেছে। কী যে এক আনন্দ, কইতে পারব না!’