মায়ের হাতের রান্না

খাবার যতই সুস্বাদু হোক, যার হাতেই রান্না হোক, মায়ের হাতের রান্নাই থাকে সবার ওপরে। যে রান্নার সঙ্গে কেউ তুলনা করতে চান না অন্য কারও রান্নার। ঈদের দিনে মায়ের হাতের বিশেষ কোনো রান্না না খেলে মনে হয় ঈদের খাওয়াদাওয়া যেন পূর্ণ হলো না। মায়ের হাতের রান্না করা বিশেষ খাবারের স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন তিনজন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, শাহাদুজ্জামান, আনিসুল হক এবং কার্টুনিস্ট ও লেখক আহসান হাবীব

মায়ের হাতের জয়দানা
ইমদাদুল হক মিলন

রোজা শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে থেকে ঈদের প্রস্তুতি শুরু করতেন মা। ঈদের দিন কী কী রান্না হবে, কোন জিনিসটা পছন্দ করে খাবে ছেলেমেয়েরা, সেসব রান্নার প্রস্তুতি।
আমি বলছি বছর পঞ্চাশ বা তারও আগের কথা।
তখনকার দিনে লাচ্ছা সেমাই বেরোয়নি। ওই জিনিসের নামও শুনিনি। সেমাই যে কিনতে পাওয়া যায়, প্যাকেটের ভেতর থাকে বা সের দরে কেনা যায়, জানতাম না। মা-খালাদের দেখতাম, নানিদের দেখতাম, বাড়িতেই সেমাই তৈরি করছেন।
দুই রকম সেমাই তৈরি করার কথা মনে আছে। এক রকমের পিতলের কল পাওয়া যেত। গ্রামের বনেদি বাড়িগুলোতে থাকত। আধা হাত পরিমাণ লম্বা। ওপরের দিকে মুঠো সাইজের চোঙা, তলার দিকে ঝাঁঝরের মতো ফুটো। এক পাশে ‘দ’ অক্ষরের মতো ডান্ডা। চোঙায় ময়দার দলা, সেদ্ধ চাল ময়দার মতো দলা পাকিয়ে ঠেসে ঠেসে ভরতে হয়। তারপর দয়ের মতো চাবিটা ঘোরাতে থাকলে নিচের ফুটো দিয়ে সরু হয়ে নামে সেমাই। এই হচ্ছে ‘কলের সেমাই’। কুলায় ওই সেমাই ছড়িয়ে রোদে শুকিয়ে রাখতে হয়। ঈদের দিন দুধ, চিনি আর নারকেল কোরা দিয়ে কলের সেমাই রান্না করতেন মা। খেলে শুধু খেতেই ইচ্ছে করে। স্বাদের তুলনা হয় না।
সোনাদিঘা আর লক্ষ্মীদিঘা ধানের চাল হতো লালচে ধরনের। সুন্দর গন্ধ। খেজুরের গুড় আর দুধ দিয়ে ওই চালের ক্ষীর রাঁধতেন মা। সঙ্গে নারকেল, কিশমিশ, খুরমা। কিশমিশ, খুরমা ব্যবহারেরও নিয়ম আছে। আগের রাতে শক্ত খুরমাগুলো লম্বালম্বি ফালি ফালি করা হতো। কিশমিশ আর খুরমার ফালি ভিজিয়ে রাখা হতো। সকালবেলা ক্ষীর যখন তৈরি হয়ে আসছে, তখন হাঁড়িতে ফেলে দেওয়া হতো ভেজানো কিশমিশ ও খুরমা।
চিনিগুঁড়া চালের পোলাও রাঁধতেন মা। খাঁটি ঘিয়ের পোলাও, সঙ্গে তেজপাতা, দারুচিনি, এলাচি, লবঙ্গ—কী অসাধারণ গন্ধ হতো! পোলাওর গন্ধে ম-ম করছে সারা বাড়ি। বাড়ির পালা মুরগির ঝাল ঝাল কষা মাংস, ঝোল আলু আর পোলাও—আহা! সেই স্বাদ আর কোথায় পাব?
চিনিগুঁড়া চালের ফিরনিও করতেন মা। চালের তুলনায় দুধের পরিমাণ বেশি। চিনির পরিমাণও বেশি। মিষ্টি হতো খুব। সঙ্গে ও রকম কিশমিশ, খুরমা, দু-চারটা এলাচি। খেতে যে কী স্বাদ!
ঈদের সকালে হচ্ছে শুধুই মিষ্টিজাতীয় খাবার। দুই রকমের সেমাই, ক্ষীর। আর দুপুরবেলা মোরগ–পোলাও, তারপর ফিরনি।
ঈদের দিনে আমার মায়ের হাতের এসব রান্নার প্রতিটাই আমি খুব মিস করি। এখনকার দিনে কত কত আইটেম তৈরি হয় বাড়িতে। কত পদের খাবার। ফেলে আসা সেসব ঈদের রান্না, আমার মায়ের হাতের রান্নার অতুলনীয় স্বাদ আর পাই না। দিন বদলেছে, স্বাদ হারিয়ে গেছে।
‘জয়দানা’ জিনিসটাকে কী বলব? সেমাই? অবসর থাকলেই মাকে দেখতাম একদলা ময়দা হাতে নিয়ে দুই আঙুলের ডগায় টিপে টিপে তৈরি করছেন জয়দানা। হাতের কাছে একটা কুলা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জয়দানা ঝাড়ছেন কুলায়। প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে, প্রতিদিন শুকানো হচ্ছে রোদে। দশ-পনেরো দিন বা কুড়ি দিনে তৈরি হয়ে গেল ঈদের সকালে রান্না করার মতো জয়দানা। ঘন দুধের সঙ্গে পরিমাণমতো চিনি, নারকেল কোরা, ভেজানো কিশমিশ ও খুরমা, তেজপাতা, এলাচি, লবঙ্গ, দারুচিনি। খেলে শুধু খেতেই ইচ্ছা করে। সেই স্বাদের খাবার আর কোথায় পাব? ও তো শুধু আমার মা-ই রান্না করতে পারতেন।

আমার মায়ের রান্নাবান্না
আহসান হাবীব
পৃথিবীর সব সন্তানের কাছে তার মা-ই সেরা রাঁধুনি। এটা নিয়ে নানা রকম কৌতুকও আছে। একটা যেমন এ রকম—স্বামী খেতে বসেছেন। স্ত্রী খাবারদাবার পরিবেশন করছেন। তখন স্বামী স্ত্রীর কোনো একটা রান্না মুখে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কী রেঁধেছ এসব? রাঁধত আমার মা...।’ তখন স্ত্রী বললেন, ‘হ্যাঁ, স্বীকার করছি তোমার মা খুব ভালো রাঁধতেন। তবে আমিও বলি, মাস শেষে আমার হাতে কী টাকা তুলে দাও তুমি...দিত আমার বাবা (মাকে...)!’
অর্থাৎ স্ত্রী বোঝাতে চাইছেন, মাস শেষে ভালো টাকা পেলে তিনিও হয়তো আরও ভালো রান্নার আয়োজন করতে পারতেন...ইত্যাদি ইত্যাদি।
তো...যেটা বলছিলাম, আমার কাছেও আমার মায়ের রান্না সব সময় অসাধারণ লাগত। সেটা আমার মা যা-ই রাঁধুন না কেন, আমার মায়ের বিশেষত্ব হচ্ছে তিনি নিজে খেতেন পাখির খাবার, (মায়ের মুখে শুনেছি আমার বাবাও তা-ই। কেউ আয়েশ করে খেতে বসলে বা খাওয়া-খাদ্যের রসালো গল্প জুড়ে দিলে বাবা নাকি ভীষণ বিরক্ত হতেন। বলতেন, ‘মানুষ কি পৃথিবীতে শুধু খাওয়ার জন্যই এসেছে?’)।
যা বলছিলাম...নিজে পাখির খাবার খেলেও কিন্তু মা অন্যদের আপ্যায়ন করতেন খুব আগ্রহের সঙ্গে। সব আয়োজন টেবিলে থাকা চাই। ‘অ্যান্টিসিপেশন’ বলে একটা শব্দ আছে কার্টুন বা কার্টুন অ্যানিমেশনে (পাঠক, ক্ষমা করবেন, নিজে কার্টুনিস্ট বলে সব সময় কার্টুন দিয়ে উদাহরণ দিই বা দিয়ে ফেলি!) কোনো একটা ঘটনা ঘটার আগের যে ‘প্রস্তুতিভঙ্গি’, সেটাই অ্যান্টিসিপেশন। আমার মায়ের রান্নার অ্যান্টিসিপেশন অসাধারণ। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। তিনি এত সুন্দর করে গুছিয়ে সবকিছু শুরু করতেন যে মুগ্ধ হওয়ার মতো।
এবার আসা যাক তাঁর রান্নায়। আগেই বলেছি, তাঁর সব রান্নাই অসাধারণ। সেটা চ্যাপা শুঁটকি থেকে শুরু করে গরুর ভুঁড়ি ভাজা—যা-ই হোক না কেন, সবই অসাধারণ, সুস্বাদু। তবে আমার মায়ের হাতের সবচেয়ে সেরা রান্না হচ্ছে সরষেবাটা দিয়ে ইলিশ মাছ। তারপরই হচ্ছে গরু বা খাসির পায়ার নেহারি। তিন নম্বরে হচ্ছে মুরগির রোস্ট।
রমজানের ঈদে মুরগির রোস্ট...আর কোরবানির ঈদে নেহারি—আম্মার রান্না করা এ দুটো ছাড়া আমাদের পরিবারের দুই ঈদ অবশ্যম্ভাবীভাবেই অসম্পূর্ণ!
এখনো ঈদ এলে ভুল করে ভেবে ফেলি, ওহ্ আম্মার রান্না করা স্পেশাল রোস্ট আর নেহারি খাওয়ার সময় চলে এসেছে। তারপরই হঠাৎ মনে পড়ে যায়...তিনি তো নেই আর আমাদের মাঝে!

নম্র হাঁড়িকাবাব আর দৃঢ় সেমাই
শাহাদুজ্জামান
একসময় প্রশ্ন জেগেছিল, আমাদের উৎসবগুলোই কি শুধু খাওয়াকেন্দ্রিক? পরে পৃথিবীর নানা প্রান্ত ঘোরার সুযোগ হলো। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ। অভিজ্ঞতা হলো তাদের প্রধান উৎসবের দিনগুলোরও। দেখলাম, ব্যাপার ওই একই। উৎসবের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে খাওয়া। নানা ধর্মের উৎসবেই খাওয়া আছে কেন্দ্রে। ঈদ, ক্রিসমাস, পূজা বা দোলপূর্ণিমা। ধর্মপরিচয় যা-ই হোক, জিবের ধর্ম তো একই। উৎসবের দিনে মনের আনন্দের অনেকটুকু জোগান দেয় মুখের স্বাদ। ঈদের দিনটিও তেমনি আবর্তিত হয় খাওয়াকে কেন্দ্র করে। আমাদের বাড়িতেও যথারীতি ঈদের প্রধান অনুষঙ্গ খাওয়া।
আম্মাকে দেখতাম আগের দিন থেকেই আয়োজন করতেন ঈদের রান্নার। আমাদের তিন ভাইকে নিয়ে ঈদের নামাজের মাঠে যাওয়ার ব্যাপারে আব্বার ছিল ব্যাপক আগ্রহ। খুব ভোরে তোড়জোড় করে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে আব্বা তাগাদা দিতেন তৈরি হয়ে নিতে। পাঞ্জাবির গায়ে নিজ হাতে লাগিয়ে দিতেন আতর। সকালের প্রথম আলোয় আতরের সুগন্ধে বাতাস ভরিয়ে আব্বার সঙ্গে ঈদগাহে যাওয়ার স্মৃতি চোখের নিচে ফুটে আছে। এরপর খাওয়ার পর্ব। প্রতিবছর আমার আম্মার রান্না করা দুটি পদ অবধারিত থাকত আমাদের ঈদের খাবারের টেবিলে। একটা হচ্ছে হাঁড়িকাবাব। কাবাব বলতেই উন্মুক্ত গনগনে শিকে ভাজা মাংসের বন্য একটা ইমেজ চোখে ভাসে। এর বিপরীতে এই হাঁড়িকাবাব বেশ নিরীহ। হাঁড়ির অন্তরালে লাজুকভাবে লুকিয়ে থাকে। দই মসলার সমন্বয়ে বেশ মাখা মাখা নম্র একটা ভাবও সেই মাংসের।
ঈদের খাওয়া বলতে আম্মার রান্না করা পোলাওর সঙ্গে কম ঝাল, মৃদু, নম্র ওই হাঁড়িকাবাবের স্বাদ লেগে আছে আমার জিবে। আর দ্বিতীয়টি ঈদের খাবারের অবধারিত পদ সেমাই। তবে এই সেমাইও প্রচলিত সেমাইয়ের বিপরীত। সেমাই বলতে নরম, এলিয়ে পড়া, দুধে ভেজা যে প্রচলিত রূপটি মনে পড়ে, এই সেমাই সেই গোত্রের নয়। খানিকটা শক্ত, ঝুরঝুরে, মুচমুচে একধরনের সেমাই, যার নাম জর্দা সেমাই।
ঈদের খাবার বলতে নমনীয় হাঁড়িকাবাব আর দৃঢ় জর্দা সেমাই। আম্মার রান্না করা এই দুটি খাবারের কথা মনে আসে আমার। আমি এখন দূর প্রবাসে, পাঞ্জাবিতে আতর লাগানোর জন্য আব্বা আর পৃথিবীতে নেই এখন। বার্ধক্য আম্মাকেও আর রান্নাঘরের চুলার পাশে দাঁড়াতে দেয় না। আমরা সবাই ক্রমে নশ্বরতার দিকে এগোই।

আম্মার হাতের লাচ্ছা
আনিসুল হক
আম্মার হাতের যে রান্নাটার কোনো জুড়ি নেই তা হলো ডাল, মসুরের ডাল। এই স্বাদ আমি ত্রিভুবনে কোথাও আর পেলাম না। আম্মার অপরূপ ডাল রান্নার একটা গোপন ট্রিক আছে, সেটা আমি আমার ঢাকার বাসায় প্রবর্তনও করেছি, কিন্তু সেই স্বাদ তো হয় না। গোপন ফর্মুলাটা হলো ডাল খুব ভালোমতো সেদ্ধ করে নিতে হবে, তারপর সেটাকে প্রাণপণে ঘুঁটতে হবে, দানা যেন মিশে যায় একেবারে ময়দার মতো। ডাল আস্ত থাকতে পারবে না। কিন্তু আম্মার একটা গোপন উপকরণ ছিল, তা হলো নিজের বাড়ির গরুর দুধ থেকে নিজ হাতে তোলা ননি থেকে নিজ হাতে বানানো ঘি। ঘি তিনি দিতেন ডালে। সে আমি ঢাকায় কোথায় পাব? আরেকটা জিনিস আমি ঢাকায় মিস করি, তবে যেকোনো রংপুরিয়া তা রান্না করতে পারেন, তা হলো ডিম আর আলুর ডাল।
ঈদে আম্মার রান্না করা সবকিছুই ভালো লাগে, সবচেয়ে ভালো লাগে লাচ্ছা সেমাই। সেটা রান্নার আম্মার কৌশল হলো দুধ জ্বাল দাও, পাঁচ কেজি দুধকে আধা কেজি বানাও, তারপর একমুঠ লাচ্ছি ঘিয়ে ভেজে সেই ক্ষীরসার ওপরে ঢালো। আম্মা রোস্ট রাঁধতেন, সেটি সুতা দিয়ে বাঁধা থাকত, মুরগি আস্ত থাকতে হবে। আমার আম্মা যে ভালো রাঁধেন, তা আমাদের বাসার সদস্যদের দেখলেই বোঝা যাবে। আরেকটা জিনিস আম্মার হাতের মতো আর হয় না, তা হলো খেজুরের গুড়ের পায়েস। এসব রান্না ভালো হওয়ার গোপন কারণটা আমি এখন বুঝতে পারি। বাড়িতে দুটো গরু ছিল, চার সের দুধ আমরা প্রতিদিন পেতাম। দুধ প্রচুর হলে দুধের জিনিস ভালো হবেই। পায়েসেও প্রচুর দুধ দিতে হবে, তারপর না পায়েস ভালো হবে।
আম্মা এখনো রংপুরে থাকেন। আমি তো সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো থেকে ঢাকায়। আমাদের ঈদ মানে বহুদিন ছিল তাই মায়ের কাছে যাওয়া। বোধ হয় আম্মারও তা-ই। ঈদ মানে ছেলেমেয়েদের কাছে পাওয়া। এখন অবশ্য আম্মাই চলে আসেন ঢাকায়। রংপুরে গেলাম মানে শুরু হলো আম্মার হাতে ভোজ-উৎসব। কবে বলেছিলাম, পুঁটি মাছ পছন্দ করি, রাজ্যের পুঁটি মাছ রান্না হচ্ছে। এক ঘণ্টা পরপর আম্মা আসবেন, বাবা, এই আমটা গাছের, তোদের জন্য ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলাম, এই পেঁপেটা এখনই গাছ থেকে পাড়া হলো। সকালে নাশতা, টেবিল ভরা খাবার, নয়টায় আবার খাবার, এগারোটায় আবার। চলছেই। কিন্তু প্রতিবার খাবার দিয়ে আম্মা গেলাস ধরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। আমরা হয়তো লেপের মধ্যে পা ঢুকিয়ে টিভি দেখছি। আমরা খাব, তিনি দাঁড়িয়ে দেখবেন। আমরা খাব, সেই খাবার তাঁর পেটেই পড়বে। তাঁর পেট ভরে যাবে। খাওয়ার পর পানি খাব, তারপর তিনি হাতের প্লেট গ্লাস নিয়ে যাবেন।
সেই পানি খেয়েই ফের যদি ঢাকা চলে আসি আমি, আম্মা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়েই থাকবেন, দাঁড়িয়েই থাকবেন, তিনি যেন বায়েজিদ বোস্তামী।