জেরেমির সোনার বাংলা

প্রথম আলো যখন এলেন জেরেমি কদ্রোঁ, একটু ইতস্তত করছিলাম কথা বলতে। একে তো ফরাসি, তায় আবার গবেষক। এ রকম একজনের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলার মতো রসদ কি আমার আছে?
জেরেমির প্রথম উচ্চারিত বাক্যই আমার যাবতীয় ভয় দূর করে দিল। ‘কী নিয়ে কথা বলব আমরা?’
তার মানে খাঁটি বাংলা ভাষাতেই হবে কথোপকথন!
বাংলা একাডেমিতে আগস্ট মাসের শেষ দিকে ‘সোনার বাংলা অ্যান্ড দ্য এস্টাবলিশড ফ্রন্টিয়ার: কলোনিয়াল হিস্টোরি অ্যান্ড লিগ্যাসি অব দ্য পার্টিশন’ নামে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। তা থেকেই তাঁর প্রতি আমাদের আগ্রহ। লম্বা, একহারা গড়নের এই মানুষটি যখন এলেন সেপ্টেম্বরের শুরুর একদিন, তখন দুপুর। ফরাসি মানুষটার জন্য এল বাংলাদেশি খাবার। তাতে সবজি, ডাল, মুরগি থাকল। থাকল কাঁচা মরিচ দিয়ে সালাদ। তিনি দিব্যি খেতে খেতে কথা বলতে লাগলেন। কাঁচা মরিচের ঝাল যে এরই মধ্যে তাঁর আয়ত্তে চলে এসেছে, তা বুঝতে ভুল হলো না।
১৯৯৮ সালে যখন বাংলাদেশে প্রথম এসেছিলেন জেরেমি, তখন বাংলা ভাষার কোনো শব্দই জানতেন না। কিন্তু এখানকার ভাষার সাংগীতিক আবহ তাঁকে আকৃষ্ট করে। বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহও জন্মেছিল তখন। দুই মাস ছিলেন বাংলাদেশে। একটু একটু করে বাংলা শব্দ শিখেছেন আর পেয়েছেন নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দ।

দুই মাস পর দেশে ফিরে প্যারিসের ইনস্টিটিউট অব দ্য ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাট সিভিলাইজেশনে (ইনালকো) বাংলা শেখা শুরু করেন। এ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ফ্রান্স ভট্টাচার্য ও ফিলিপ বেনোয়া।

বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থেকে পড়তে শুরু করেন বঙ্কিম, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, মানিক। তখনই ‘সোনার বাংলা’ শব্দটির প্রয়োগ নিয়ে ভাবনা আসে তাঁর মনে। ‘সোনার বাংলা’ জাতীয় প্রতীক হিসেবে কী করে স্থান করে নিল বাঙালির ধমনিতে, তা নিয়েই গবেষণা চালিয়ে যান তিনি।

নান রুটিতে ডাল মাখিয়ে মুখে তুললেন জেরেমি। তারপর খেতে খেতেই বললেন, আমার ভাবনা ছিল এ রকম, সোনার বাংলার ইতিহাস খুঁজতে গেলে প্রথমেই এর মধ্যে রোমান্টিকতার আঁচ পাওয়া যায়। এটা ছিল একটা চ্যালেঞ্জ, এই চ্যালেঞ্জ উপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে জাগরণের, বাঙালি সংস্কৃতির সমালোচনাকারী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয় ভাবনাটি ছিল, বিংশ শতাব্দীর ২০ থেকে ৪০ দশক পর্যন্ত সময় নিয়ে। এ সময় সাম্প্রদায়িকতার আভাস পাওয়া যায় বাংলায়। সব ধর্ম-বর্ণ মিলেমিশে যে সোনার বাংলার কথা ভাবা হয়েছিল, সেটা নড়ে যায়। বিভেদ তৈরি হয়। তৃতীয় ভাবনাটি ছিল ১৯০৬ সালে নিখিলনাথ রায়ের লেখা চারটি প্রবন্ধ থেকে নেওয়া। তিনি বলেছিলেন, সোনার বাংলা ধারণাটি সাম্প্রদায়িকতার কারণে দুর্বল হবে। তিনি চিন্তিত হয়ে বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে ‘সোনার বাংলা জাগিবে কি’? পাকিস্তান হওয়ার পর বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি বিপদের মধ্যে ছিল। সেই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই ছিল বাংলাদেশ আন্দোলন।

বাংলাদেশের জন্মমুহূর্ত পর্যন্তই তাঁর গবেষণার স্থিতি।

যে মানুষটি বাংলার প্রতি এত ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছেন বুকে, তাঁকে শুধু কাটখোট্টা গবেষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। তাই অন্যদিকে চলে গেলাম আমরা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাংলাদেশের কোন ব্যাপারটা ভালো লাগে?’

‘গান’। নির্দ্বিধায় বললেন তিনি। ‘পৃথিবীর আর কোন দেশে দেখতে পাবেন, যেকোনো জায়গায় মন খুলে গান করছে মানুষ?’

‘আপনি কোনো গান শিখেছেন?’ হাসলেন জেরেমি। সেই আটানব্বই সালে শুনেছিলাম ‘পুরানো সেই দিনের কথা’। তখন বুঝিনি, কিন্তু মেলোডিতে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বুঝেছিলাম এই গানে নস্টালজিয়া আছে। বাংলাদেশের যে আসল দেশ মানে গ্রাম, তার কথাও আছে। আমি তো এবার আরও অনেক গান শুনেছি। ভাটিয়ালি, মাইজভান্ডারি, গ্রামের গান...। একবার এক গ্রামের স্কুলে গিয়েছিলাম, শিশুরা আমাকে
শোনাল ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এ রাজার রাজত্বে’। আরও কিছু শিখেছি।

তারপর যোগ করলেন, ‘জানেন, আমি বুঝতে পারছি, লোকগানের পুনর্জন্ম হচ্ছে আবার। আধুনিক আর ঐতিহ্যবাহী লোকগান মিলেমিশে গেছে। ফ্রান্সেও কিন্তু এমনটা ঘটছে।’

আমাদের দেশের কোন ব্যাপারটা খারাপ লাগে?

এবারও ভাবার জন্য সময় নেন না জেরেমি। বলেন, ‘ঢাকা শহরের যানজট আর প্রচণ্ড শব্দ। আর ওই বায়ুদূষণ..।’

১৫ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে যাওয়ার কথা জেরেমির। আবার কি আসবেন এই দেশে?

বললেন. ‘আসতেই হবে। বাংলা একাডেমির পাঠাগারে পড়াশোনা করব। এখানে তথ্যের আকর আছে। আগামী বছর জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত থাকব এখানে। মূলধারার সাহিত্যের পাশাপাশি নিম্নবর্গের ইতিহাস পড়ব এবার।’

ফ্রান্সে কি করেন এখন?

‘“ইনালকো”তেই পড়াই। এখন রবীন্দ্রনাথের গোরা পড়াচ্ছি। গোরা পড়ে আমার কিন্তু জীবন বদলে গিয়েছিল!’

গান তো শিখেছেন বললেন, শোনান না একটা গান!

জেরেমি গান ধরলেন, ‘তিন পাগলে হলো দেখা নদে এসে’। সেটা শেষ হতেই ধরলেন, ‘সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী।’

ফরাসি মানুষটাকে এখন গানে পেয়েছে।