নারীরা অর্থনৈতিক নির্যাতনেরও শিকার

নারীর পক্ষে পুরুষ
নারীর পক্ষে পুরুষ

বাংলাদেশে নারীর ওপর স্বামীর অর্থনৈতিক নির্যাতনের হার জাতিসংঘের মাপকাঠিতে খুব বেশি নয়। তবে আরও কয়েকটি মাপকাঠি যোগ করে দেশীয় মানদণ্ডে দেখা যায়, বিবাহিত নারীদের প্রায় অর্ধেকই জীবনে কখনো না কখনো স্বামীদের হাতে অর্থনৈতিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। আর জীবনকালে অন্তত একবার হলেও স্বামীর হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন নারীর সংখ্যা ৮০ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৫ সালে নারী নির্যাতনের ওপর যে খানাভিত্তিক জরিপ করেছে, তাতে এ চিত্র বেরিয়ে এসেছে। বিবিএসের এটা দ্বিতীয় ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে। প্রথমটি হয়েছিল ২০১১ সালে।
জাতিসংঘের মানদণ্ডে অর্থনৈতিক নির্যাতনের মাপকাঠি হচ্ছে হাতে টাকা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রী তথা সঙ্গিনীর হাতে পর্যাপ্ত সংসারখরচ না দেওয়া। জরিপে দেখা যায়, বিয়ের অভিজ্ঞতা আছে এমন নারীদের প্রায় ১১ শতাংশ জীবনকালে অন্তত একবার এ নির্যাতন ভোগ করেছেন। প্রায় ৭ শতাংশ জরিপ-পূর্ববর্তী এক বছরে এর ভুক্তভোগী হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের আলাদা কোনো কার্যক্রম নেই। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যেসব আইন, নীতি ও কার্যক্রম আছে, সেগুলোর মধ্যেই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। তিনি বলেন, শুধু আইন দিয়ে যৌতুক বা অন্য অর্থনৈতিক চাপ ও নিপীড়ন ঠেকানো যায় না। অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা চাই। মেয়েদের মানসিক শক্তি বাড়াতে হবে, নিজেকে শ্রদ্ধা করতে হবে।’

এদিকে দেশীয় কিছু সূচক যুক্ত হলে জীবনকালে এমন অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকারের হার দাঁড়ায় ৪০ শতাংশ। আর গত ১২ মাসের জন্য এ হার দাঁড়ায় ১৪ শতাংশ। এ দেশের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক নির্যাতনের ব্যাপ্তি বোঝার জন্য গবেষকেরা জরিপের দেশীয় মানদণ্ডে কয়েকটি সূচক যোগ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে স্ত্রীকে নিয়মিত হাতখরচ না দেওয়া, যৌতুক দাবি করা এবং বাবার বাড়ি থেকে টাকা বা জিনিসপত্র আনতে চাপ দেওয়া।

এ ছাড়া জরিপটি নারীর নিজ আয়ে নিয়ন্ত্রণ না থাকা এবং দেনমোহর না পাওয়ার চিত্রও দেখেছে। তবে সেটা অর্থনৈতিক নির্যাতনের হিসাবে নেয়নি।

এই প্রতিবেদক রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের নানা বয়সী ৫০ জন বিবাহিত নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন। এঁদের মধ্যে ৪৪ জন বলেছেন, স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁদের অর্থনৈতিক নিপীড়ন করেন। ঢাকার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের স্ত্রী বলেন, স্বামী তাঁকে সংসার চালাতে মাসে মাত্র ২৫ হাজার টাকা দেন। এ টাকায় বাসাভাড়া ও বিল, খাওয়ার খরচ, বাচ্চাদের স্কুলের খরচ দিয়ে কুলায় না। আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ধারকর্জ করে তিনি সংসার চালান। স্বামীর সাফ কথা, বাড়তি এক টাকাও তিনি দেবেন না।

বিবিএসের জরিপ বলছে, এক-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি নারীর বিয়ে হয় যৌতুক দেওয়ার শর্তে। আবার প্রায় ১০ শতাংশ নারীকে স্বামীরা বাবার বাড়ি থেকে টাকাপয়সা, জিনিসপত্র আনতে চাপ দিয়েছেন।

রাজশাহীর মেয়ে রিফাহ তাসফিয়া ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যৌতুক দিতে রাজি না হওয়ায় বিয়ের দেড় বছরের মাথায় গত ১১ জুলাই স্বামী পিটিয়ে তাঁর বুক-পিঠের হাড় ও হাত-পা ভেঙে দিয়েছেন।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি ২০১৫ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৫০০টি। এগুলোর মধ্যে ২৯৬টি ঘটনায় নারীরা নিহত হয়েছেন বা আত্মহত্যা করেছেন। আসক আটটি দৈনিক পত্রিকার খবর ও নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এ হিসাব করেছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলছেন, যৌতুক নেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। তাঁর মতে ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনটির সংস্কার দরকার। দৃশ্যমান শাস্তি চান। আর তিনি বলেন, যৌতুকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

বিবিএসের জরিপ দেখাচ্ছে, জীবনকালে স্বামীর কাছ থেকে হাতখরচ না পাওয়ার অভিজ্ঞতা বিবাহিত নারীদের প্রায় ১৭ শতাংশের। গৃহিণী ফিরোজা আক্তারের ব্যবসায়ী স্বামী সামর্থ্য থাকলেও স্ত্রীকে কোনো হাতখরচ দেন না। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্যও তিনি টাকা দিতে চান না। ফিরোজা প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো দরকারে বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে হয়। ফিরোজা স্নাতকোত্তর পাস। কিন্তু স্বামী ও শ্বাশুড়ি তাঁকে চাকরি করতে দেন না।

দেশজুড়ে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী নারীদের প্রতিনিধিত্বশীল এই জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯২ ভাগেরই বিয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। নারী নির্যাতনের হদিস করতে গিয়ে জরিপটি আলাদা করে বর্তমানে বিবাহিত নারীদের পরিস্থিতিও দেখেছে। দেখা গেছে, অর্থনৈতিকসহ সব রকম নির্যাতন মিলিয়ে নারীরা স্বামীর হাতেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন। জরিপের দেশীয় মাপকাঠি ধরলে স্বামীর হাতে অর্থনৈতিক নির্যাতনের হার শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে খুব কম নয়।

২০১৫ সালের জরিপে জীবনকালে বিবাহিত এবং বর্তমানে বিবাহিত নারীদের মধ্যে অর্থনৈতিক নির্যাতনের হারে খুব বেশি তফাত দেখা যায়নি। ২০১১ সালের জরিপটির তুলনায় এবার অর্থনৈতিক নির্যাতনের হার মোটের ওপর কয়েক পয়েন্ট করে কমেছে।

মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, স্বামী বিয়ের সময় স্ত্রীকে নির্ধারিত অঙ্কের টাকা বা সম্পদ দেনমোহর হিসেবে দিতে বাধ্য। জরিপে দেখা যায়, বিবাহিত নারীদের মাত্র ১২ শতাংশ দেনমোহরের পুরো অর্থ বুঝে পেয়েছেন। আর ২৩ শতাংশের মতো আংশিক মোহরানা পেয়েছেন।

আসকের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক আইনজীবী নীনা গোস্বামী বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তালাকের আগে নারীরা দেনমোহর পান না। পারিবারিক অশান্তি এড়াতে তাঁরা সাধারণত এটা দাবিও করেন না। এদিকে হিন্দু নারীরা বিয়ের সময় বাবার বাড়ি থেকে যে টাকা বা সম্পত্তি পান, সেটা আইনত স্ত্রীধন হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা। কিন্তু নীনা বলছেন, বাস্তবে এটা হয় না।

জরিপভুক্ত বিবাহিত নারীদের ৮৫ শতাংশের নিজেদের আয়ের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নাসিমা আলম ২৫ বছর ধরে চাকরি করছেন। তাঁর বর্তমান বেতন ৮০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, বরাবর তাঁর বেতনের পুরো টাকা স্বামী নিয়ে নেন। দৈনন্দিন খরচের টাকাও মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করে আদায় করতে হয়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলছেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। পরিবারেও তার অবস্থান ভালো হচ্ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই নারী নিজের অর্জিত টাকা ভোগ করতে পারে না। ড. নাজনীন বলেন, ‘পরিবারের অর্থ ব্যয়ের সিদ্ধান্ত প্রায় শতভাগ সরাসরি অথবা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে পুরুষেরাই নিচ্ছেন।’