নারীর প্রতি আর সহিংসতা নয়

নারীকে নির্যাতন নয়, ভালোবাসুন। মডেল হয়েছেন অন্তরা ও ইমরান l ছবি: সুমন ইউসুফ
নারীকে নির্যাতন নয়, ভালোবাসুন। মডেল হয়েছেন অন্তরা ও ইমরান l ছবি: সুমন ইউসুফ

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার মতো বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এসডিজির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূলকরণে বিশেষভাবে নির্ভরশীল কয়েকটি বিষয়ে একমত হয়েছে। এসবের মধ্যে তৃতীয়, পঞ্চম ও ষোড়শ লক্ষ্য উল্লেখযোগ্য। লক্ষ্য তৃতীয়: সুস্বাস্থ্য ও ভালো থাকা; লক্ষ্য পঞ্চম: জেন্ডার সমতা এবং নারী ও কিশোরীদের ক্ষমতায়ন। সেই সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতার অবসানের আহ্বান; এবং লক্ষ্য ষোড়শ: শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন।

তথ্য মতে, সহিংসতার ঝুঁকিতে থাকা মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা বড় হয়ে সহিংস আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়তে পারে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের আগে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বেশ কয়েকটি সনদ গ্রহণ করেছে, যেগুলো উন্নয়নের শর্ত হিসেবে নারী, অল্পবয়সী মেয়ে এবং শিশুদের প্রতি

.
.

সহিংসতার নিরসনকে গুরুত্ব দেয়। এসব সনদ হচ্ছে:
১৯৪৫: মানবাধিকার সনদ
১৯৭৯: নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা নির্মূল করার নীতিমালা (সিডও)
১৯৯০: শিশু অধিকার সনদ (সিআরসি)
১৯৯৪: আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা সম্মেলন এবং উন্নয়নের কর্মপরিকল্পনা (আইসিপিডি পিওএ)
১৯৯৫: বেইজিং কর্মপরিকল্পনা
২০০০: সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি)
২০১৫: টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)
সমস্যার গভীরতা অনুধাবন করে জ্ঞান ও তথ্যের মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে নারীর প্রতি সহিংসতাকে আরও ভালোভাবে মোকাবিলার উপায় শেখানো যেতে পারে। তাই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে জাতিসংঘ পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে যেন সদস্য দেশগুলো নারীর প্রতি সহিংসতার সূচক পরিমাপের জন্য নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে কার্যকর পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) নারীর প্রতি সহিংসতার ব্যাপকতা যাচাই করতে বিভিন্ন সূচক নির্ধারণের জন্য ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো একটি জরিপ করে। ২০১৫ সালে দ্বিতীয়বারের মতো জরিপটি করা হয় এবং অতি সম্প্রতি পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউএনএফপিএ এ জরিপের প্রতিবেদন যৌথভাবে প্রকাশ করেছে।

জরিপে বর্তমান এবং সাবেক স্বামী অথবা ঘনিষ্ঠজন এবং পরিবারের বাইরে অন্য পুরুষের হাতে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা এবং ব্যাপ্তি চিহ্নিত করা হয়। প্রতিবেদনে সহিংসতার এক ধারাবাহিক চিত্র ফুটে উঠেছে।

নারীর প্রতি সহিংসতার আর্থিক ক্ষতি

নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতা যে কেবল তাদের ব্যক্তি অধিকার ক্ষুণ্ন করে, তা নয়। অপরাধীরা প্রায় সময়ই বিচারহীনতার সুযোগ নিয়ে এমন সব কর্মকাণ্ড করে থাকে যে সকল নারী ও মেয়েদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। এর ফলে একটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর সুদুরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

নারীর প্রতি সহিংসতার অর্থনৈতিক মূল্য পরিবারের পাশাপাশি গোটা জাতিকে বহন করতে হয়। এটা নিরূপণ করা সহজ নয়। তবে বেসরকারি সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশের এক গবেষণা অনুযায়ী, এর মূল্য বেশ উল্লেখযোগ্য । নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতার মোট ব্যয় জাতীয় পর্যায়ে কমপক্ষে ১৪ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। এটা সরকারের ২০১০ সালের মোট ব্যয়ের ১৩ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ১ শতাংশ। এই ব্যয় ২০১০ সালে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে মোট ব্যয়ের প্রায় কাছাকাছি। পরিবার, সম্প্রদায় এবং জাতীয় পর্যায়ে আরও বেশি সম্পদের সংস্থানের জন্য বিনিয়োগ করলে নারীর প্রতি সহিংসতার নেতিবাচক প্রভাবগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। কারণ, এই সহিংসতার কারণে দারিদ্র্যের মাত্রা বাড়ে, উন্নয়নের গতি ব্যাহত হয় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও থেমে যায়।

নারীর প্রতি সহিংসতা বহুমাত্রিক এবং এটা মোকাবিলায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যেমন: ক) সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন, যা সর্বস্তরের মধ্যে সহিংসতার প্রতি অভিন্ন মনোভাব তৈরি করবে। সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে; খ) আইনি ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করতে হবে। অভিযোগ রয়েছে নির্যাতনের শিকার নারীরা যথাযথ সহায়তা ও পুলিশি সাহায্য পান না। পুলিশের ডেটাবেইসে সঠিকভাবে রেকর্ড রাখা হয় না। ফলে আদালতে সেসবের বিবরণ তুলে ধরা কঠিন হয়ে পড়ে; গ) দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে আদালতে মামলার কার্যক্রম সম্পন্ন করা এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; ঘ) নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ অন্যান্য বিষয়ের সাড়া ।

নারীর প্রতি সহিংসতার স্বাস্থ্যগত পরিণামসমূহ

দাম্পত্য জীবনে নারীর ওপর মানসিক ও শারীরিক নিপীড়নকে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করা হয় যা গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি গর্ভাবস্থায়ও তাদের নির্যাতন করা হয়। তথ্য-উপাত্ত বলছে যে, সহিংসতার কারণে বিশেষত ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরী-তরুণী মায়েদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে।

নারীর প্রতি সহিংসতার মানবিক উদ্যোগ

যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো জরুরি অবস্থায় সকলেরই সমস্যা বেড়ে যায়। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও নিপীড়ন কয়েক গুণ বেশি হয়। যেকোনো ​দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য তাদেরকে অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। এমনকি এ সময়টায় তারা পরিবারেও নির্যাতিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। কখনো কখনো বাবা–মায়েরা ভয় থেকে নিরুপায় হয়ে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেন। যার ফলে তারা পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে রোজগারের জন্য কাজে পাঠানো হয় এবং কখনো কখনো তাদের পাচারও করা হয়। যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ছেলে বা পুরুষেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু নারী ও কিশোরীরা অনেক গুণ বেশি ও অপূরণীয় ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে।

 এ পরিপ্রেক্ষিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে একটি সম্ভাব্য কাঠামো গড়ে তোলার জন্য সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করেছে (Genderbased Violence

​Cluster)। এতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ইউএনএফপিএ সহপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশে এটা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এই উদ্যোগকে সফল ও বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তাহলেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে সমন্বিতভাবে নারীর প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধ করা যাবে।

নারীর প্রতি সহিংসতা এখনই শেষ করতে হবে

 নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবিলা কোনো সহজ কাজ নয়। এ জন্য বহুমুখী কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। জাতীয় পর্যায়েও একটি সমন্বিত পরিকল্পনা এবং পর্যাপ্ত বাজেট অত্যন্ত দরকার।

* নারীর প্রতি সহিংসতা অগ্রহণযোগ্য, এটা প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক মূল্যবোধ বদলাতে হবে। এ জন্য পুরুষের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রয়োজন। পুরুষেরাই নারীর পাশে দাঁড়াবেন এবং নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলবেন, এমনটাই প্রত্যাশা। তাহলেই নারী ও মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।

* তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যেই পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে হবে। শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীরা প্রয়োজনীয় দক্ষতা নিয়ে গড়ে উঠতে পারলে পরস্পর সম্মানজনক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে। আইনের যথযথ প্রয়োগ হলে কেউ নারীর প্রতি সহিংসতা করে পার পাবে না। এবং এভাবেই নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে।

*একই সঙ্গে নারী ও কিশোরীদের জন্য অব্যাহত বিনিয়োগ প্রয়োজন। তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং পারিবারিক নিরাপত্তা, বিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্র এবং প্রকাশ্য স্থানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

* নারীর প্রতি বিভিন্ন রকমের সহিংসতা দূর করতে নারীর ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর একজন নারীর প্রয়োজনীয় আইনি ও চিকিৎ​সা সহায়তার সুযোগ পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট বিভাগ যেন যৌন সহিংসতার মামলার কার্যক্রমে অবহেলা রুখতে কার্যকর ব্যবস্থা নেন। নারীরা যেকোনো ধরনের শারীরিক, মানসিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানির শিকার হলে এবং অল্পবয়সী মেয়ে ও শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও প্রকাশ্য স্থানে হেনস্তা হলে তা দমনে জোরালো ব্যবস্থা নিতে হবে।

নারীর প্রতি সহিংসতাকে না বলুন

আপনি কি ওপরে লিখিত যে কোনো একটি সহিংসতার শিকার অথবা প্রত্যক্ষদর্শী? তাহলে সহায়তার জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হেল্পলাইনে (১০৯২১) ফোন করুন।

ইউএনএফপিএর একটি প্রতিবেদন থেকে অনূদিত