এ দেশে একসময় বাল্যবিবাহ বলে কিছু থাকবে না

>
প্রথম আলো কার্যালয়ে আর্জেন্টিনা মাতাভেল পিচ্চিন l ছবি: জাহিদুল করিম
প্রথম আলো কার্যালয়ে আর্জেন্টিনা মাতাভেল পিচ্চিন l ছবি: জাহিদুল করিম
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) প্রতিনিধি আর্জেন্টিনা মাতাভেল পিচ্চিন তিন বছর চার মাস বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেন। বিদায় নেওয়ার আগে প্রথম আলো কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। পাশাপাশি প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বাল্য বিবাহসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রোকেয়া রহমান

প্রথম আলো: আপনি তিন বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে কাজ করেছেন। ইউএনএফপিএ যেসব কর্মসূচিতে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করছে, তার মধ্যে কোনটিতে অগ্রগতি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

আর্জেন্টিনা মাতাভেল: বাংলাদেশ এ পর্যন্ত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৫ নম্বর লক্ষ্য অর্জন করেছে। সেটি হচ্ছে মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০০১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ কমেছে। ২০০১ সালে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি লাখে ৩২২ জন মা মারা যেতেন। ২০১০ সালে এ হার লাখে ১৭০ জনে নেমে আসে। এটা অবশ্যই একটি সাফল্য। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য হচ্ছে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনা। এ জন্য বাংলাদেশকে আরও অনেক কাজ করতে হবে। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু বা মাতৃত্বজনিত অসুস্থতার একটি বড় কারণ হচ্ছে বাড়িতে অদক্ষ ধাইয়ের মাধ্যমে সন্তান প্রসব। সন্তান প্রসবের সময় অবশ্যই দক্ষ ও পেশাদার মিডওয়াইফ দরকার। বাংলাদেশের সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। মিডওয়াইফারি সেবা প্রসারের মাধ্যমে মাতৃমৃত্যু কমিয়ে আনার জন্য সরকার ৩১টি সরকারি নার্সিং কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্স চালু করেছে। ইতিমধ্যে ৬০০ পেশাদার মিডওয়াইফকে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জানুয়ারি মাসে দেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আরও ৯০০ মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়া হবে। নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করতে অবশ্যই প্রসবের সময় মিডওয়াইফের উপস্থিতি দরকার। প্রসবোত্তর সেবা ও পরিবার পরিকল্পনাসংক্রান্ত দানের ক্ষেত্রেও মিডওয়াইফরা কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। আমি আশা করছি, পেশাদার মিডওয়াইফদের আরও বেশি সংখ্যায় নিয়োগ দেওয়া হলে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

প্রথম আলো: কী কী কারণে বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে যেতে পারছেন না বলে আপনি মনে করেন?

আর্জেন্টিনা মাতাভেল: নারীর প্রতি সহিংসতা তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ সরকার অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি করলেও এই জায়গাটায় পিছিয়ে আছে। নারী ও কিশোরীদের প্রতি সহিংসতা কিছুতেই থামছে না। এমনকি মেয়েশিশুরাও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। নিজের পরিবারেও তারা নিরাপদ নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী বিবাহিত ৮০ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হন। এটা খুবই দুঃখজনক। সহিংসতার শিকার নারীরা দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারেন না। ফলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হয়।

প্রথম আলো: এ ব্যাপারে সরকারের করণীয় সম্পর্কে একটু বলবেন কি?

আর্জেন্টিনা মাতাভেল: সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতাকারীদের কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। তারা যেন কোনোভাবে পার না পায়, সে রকম ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের বাল্যবিবাহের পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

আর্জেন্টিনা মাতাভেল: বাল্যবিবাহ হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এখন এ দেশে বাল্যবিবাহের হার ৬৬ শতাংশ। তবে সবাই মিলে যেভাবে কাজ করছে, তাতে আমার বিশ্বাস, পাঁচ বছর পর এ দেশে বাল্যবিবাহের হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে। এরপর খুব দ্রুত শূন্যে নেমে আসবে এ হার। মন্ত্রিসভায় এ ব্যাপারে একটি খসড়া আইন অনুমোদন হয়েছে। অনেক সাংসদ তাঁদের এলাকায় বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধের উদ্যোগ নিচ্ছেন। ইউএনওরা বাল্যবিবাহের খবর পেলেই তা বন্ধ করে দিচ্ছেন। অনেক মেয়ে নিজের বাল্যবিবাহ নিজেই বন্ধ করছে। ফলে আমি আশাবাদী যে এ দেশে একসময় বাল্যবিবাহ বলে কিছু থাকবে না।

প্রথম আলো: বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের খসড়ায় মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানো-সংক্রান্ত বিশেষ ধারা বহাল রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

আর্জেন্টিনা মাতাভেল: আমি খসড়া আইনটি দেখিনি, কেবল শুনেছি। কাজেই আমি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করব না।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার সার্বিক পর্যবেক্ষণ কী?

আর্জেন্টিনা মাতাভেল: বাংলাদেশ খুব সুন্দর একটি দেশ। তবে রাস্তার যানজটটাই সবচেয়ে খারাপ। এ দেশের মানুষেরা খুবই অতিথিবৎসল। তারা খুবই পরিশ্রমী। বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। বাংলাদেশ থেকে আমি অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। এগুলো আমি আমার নিজের দেশে (মোজাম্বিক) গিয়ে কাজে লাগাব।