প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়টি শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত

>

বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই প্রজননস্বাস্থ্যের পরিচর্যা শুরু করা উচিত হলেও আমাদের দেশে এ বিষয়ে কোনো সচেতনতা নেই। বিষয়টি নিয়ে অনেকেই কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। স্কুলপর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকেও এ নিয়ে তেমন কোনো তথ্য নেই। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয় নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এস এম ওয়াহিদুজ্জামানের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইসমাইল সাদী।

এস এম ওয়াহিদুজ্জামান
এস এম ওয়াহিদুজ্জামান

প্রথম আলো: আপনার অধিদপ্তরের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের উন্নয়নে কী ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে? এসব কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা, সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
ওয়াহিদুজ্জামান: মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক ‘জেনারেশন ব্রেকথ্রু’ নামের একটি প্রকল্প ঢাকা মহানগর, বরিশাল শহর, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের নির্বাচিত ৩০০টি বিদ্যালয় ও ৫০টি মাদ্রাসায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় রয়েছে বাংলাদেশে নেদারল্যান্ডসের দূতাবাস ও ইউএনএফপিএ। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ১০-১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মাঝে লিঙ্গসমতাভিত্তিক আচরণ ও সম্মানবোধ তৈরি, যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বৃদ্ধি এবং জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি। এই প্রকল্পের আওতায় মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে:
*‘সবার জন্য জেন্ডারসমতা’ ম্যানুয়াল অনুসরণ করে কিশোর-কিশোরীদের জেন্ডার-সাম্য বিষয়ে সচেতনতামূলক শিক্ষা প্রদান।
*শিক্ষা-সহায়ক গেমস উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক শিক্ষা প্রদান।
*‘দশ-উনিশের মোড়’ হেল্পলাইন পরিচালনার মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে কাউন্সেলিং ও রেফারেল সেবা প্রদান।

*পথনাটক ও অ্যাডভোকেসি সভা আয়োজনের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি।

*ক্রীড়াভিত্তিক পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে কিশোর খেলোয়াড়দের মাঝে জেন্ডার-সাম্য আচরণ এবং সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে শিক্ষা প্রদান।

*ž‘দশ-উনিশের মোড়’ রেডিও প্রোগ্রামের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের উন্নয়নে সচেতনতা সৃষ্টি।

*সারা বিশ্বে কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের উন্নয়নে মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সরকারও এই বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে ইতিমধ্যেই শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার ধারাবাহিকতায় জেনারেশন ব্রেকথ্রুর মতো প্রকল্প সরকার গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়ন করছে।

* জেনারেশন ব্রেকথ্রু কর্মসূচিতে সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত থাকায় প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। পরে এসব চ্যালেঞ্জ সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করা হয়েছে এবং প্রকল্প কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

প্রথম আলো: এ ধরনের কর্মসূচি মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির কোনো পরিকল্পনা কি সরকারের রয়েছে?

ওয়াহিদুজ্জামান: বর্তমান শিক্ষাক্রমে জীবন দক্ষতাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় ইতিমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে শিক্ষাক্রমের বিষয়বস্তু বিভিন্ন বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে নিয়মিত পরিমার্জন, সংশোধন ও পরিবর্তন করা হয়। প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়টি শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্পটি সরকারের একটি পাইলট প্রকল্প। এই প্রকল্পের অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মসূচি মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি সরকার গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে।

প্রথম আলো: কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে?

ওয়াহিদুজ্জামান: আমাদের সমাজ এখনো অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রচলিত রক্ষণশীল মূল্যবোধ ও মনোভাবের কারণে এ ধরনের সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সরাসরি কথা বলতে অনেকেই দ্বিধাবোধ করেন। অনেক ক্ষেত্রেই নারী শিক্ষক পুরুষ সহকর্মীর কাছ থেকে এমনকি নারী সহকর্মীদের কাছ থেকেও বাধা পান এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে। আবার এটাও দেখা গেছে, মেয়ে শিক্ষার্থীরা যতটা আগ্রহ এবং ইতিবাচকভাবে বিষয়গুলো গ্রহণ করেছে, ছেলে শিক্ষার্থীরা তা করেনি। বরং তাদের আচরণে বিষয়গুলো সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ পেয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের যথাযথ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত করা হয়। ফলে খুব অল্প সময়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা পরিলক্ষিত হয়েছে।

প্রথম আলো: সরকারি নীতি বা কৌশল এ ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়নে কতটুকু সহায়ক? আপনি কি মনে করেন এই নীতিমালার কোনো পরিবর্তন বা সংশোধন করা উচিত?

ওয়াহিদুজ্জামান: বর্তমান সরকার বিভিন্ন নীতিমালার মাধ্যমে কৈশোরবান্ধব অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর কথা বলা যেতে পারে। এই শিক্ষানীতি অনুযায়ী মাধ্যমিক স্তরে শেষের দুই বছরের পাঠ্যক্রমে জেন্ডার স্টাডিজ ও প্রজননস্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্তকরণের কথা বলা হয়েছে (পৃষ্ঠা: ৪০)। জাতীয় শিশুনীতি ২০১১-এর মূলনীতিতে কন্যাশিশুর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্য দূরীকরণের কথা বলা আছে (পৃষ্ঠা: ১৩)।রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। সুতরাং নাগরিকদের সুবিধা বিবেচনায় প্রয়োজনে নীতিমালায় পরিবর্তন বা সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে নীতিমালা পরিবর্তন বা সংশোধন করা যেতে পারে।