'আফাকে ভ্যানে ঘুরাতে পারছি, তাতেই আমি ধন্য'

গত ২৭ জানুয়ারি ইমাম শেখের ভ্যানে প্রধানমন্ত্রী। ছবি: ফোকাস বাংলা
গত ২৭ জানুয়ারি ইমাম শেখের ভ্যানে প্রধানমন্ত্রী। ছবি: ফোকাস বাংলা

‘আমি আফাকে ভ্যানে ঘুরাতে পারছি, তাতেই আমি ধন্য। আমি আফার কাছ থেকে টাকা নেব না।’ টুঙ্গিপাড়ার ভ্যানচালক ইমাম শেখ এ কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের। গত ২৭ জানুয়ারির ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় নিজের বাড়িতে গিয়েছিলেন। রিকশাভ্যানে চেপে ঘুরেছিলেন বাড়ির আশপাশ এলাকা। ইমাম শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ভ্যান থেকে নেমে প্রধানমন্ত্রী নতুন বাসায় ঢুকে যান। ‘আমি অপেক্ষা করি। কিছুক্ষণ পর সিকিউরিটির লোকজন এসে আমাকে টাকা দিতে চান। আমি টাকা নিতে চাই না। তখন ভ্যানভাড়া দেওয়ার জন্য সিকিউরিটির লোকেরা জোর করেন। তারপরও আমি টাকা ফিরিয়ে দেই। বলি, কী বলেন! আফা আমার ভ্যানে চড়েছেন, এতেই আমি ধন্য। এর জন্য আমি টাকা নেব? তখন তাঁরা বলেন, যাও তোমার ডিউটি শেষ। এরপর আমি চলে আসি।’ বললেন ইমাম শেখ।
এর পরের ঘটনাগুলো সবারই জানা। প্রধানমন্ত্রীকে নিজের রিকশাভ্যানে বহন করে ইমাম শেখের জীবন বদলে যায় রাতারাতি। সেই রিকশাভ্যানও হয়ে গেছে দর্শনীয় বস্তু। সর্বশেষ ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী পরিচালিত বেকারির চাকরিতে যোগ দিয়েছেন ইমাম শেখ।

ইমাম শেখ
ইমাম শেখ

ইমাম শেখের একদিন
রিকশাভ্যানের চালক ইমাম শেখের কাছে ২৭ জানুয়ারি দিনটির শুরুও ছিল আর দশটা সাধারণ দিনের মতোই। সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে ওঠেন ইমাম শেখ। হাত-মুখ ধুয়ে রাতে চার্জে দিয়ে রাখা ভ্যানটি নিয়ে বের হয়ে পড়েন সকাল সাতটার দিকে। তখন সকাল সাড়ে ১০টা। আশপাশে কয়েকটা ভাড়া নেওয়ায় ইমামের আয় হয়েছে ৯০ টাকা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতি বাসস্ট্যান্ডে। হঠাৎ দুই ব্যক্তি এসে ইমামের ভ্যানে চেপে বসেন। ইমামকে ভ্যান চালিয়ে নিয়ে যেতে বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের ১ নম্বর গেটের দিকে।
ইমাম জানতেন, টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী। নিরাপত্তাজনিত কারণে কিছু কিছু জায়গায় ভ্যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। ওই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সৌধের ১ নম্বর গেটও রয়েছে। কিন্তু তাঁর ভ্যানে চড়ে বসা দুই ব্যক্তির পোশাক ও চেহারা দেখে ইমামের বুঝতে ভুল হয়নি তাঁরা কারা। তাই ভ্যান চালানো শুরু করেন। ১ নম্বর গেটের সামনে গিয়ে ভ্যান থামান ইমাম।
ইমাম শেখেরটাসহ দুটি ভ্যান নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ১ নম্বর গেটে। তাঁর ভাষায়, অন্য ভ্যানটির ‘বডি কন্ডিশন’ ভালো না থাকায় সেটা বিদায় করে দেওয়া হয়। ইমাম বলেন, ‘একটু পরেই আফা এসে হাজির হন। আমি তাঁকে সালাম দেই। তিনি সালামের জবাব দেন। এরপর তিনি আমাকে বলেন, তুমি ভ্যান চালাও? আমি বলি, আফা। আমি ভ্যান চালাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তোমাদের সব ভ্যান ইঞ্জিন হয়ে গেছে। আমার বিদ্যুৎ নষ্ট করতেছ তুমি। বলে হেসে দেন আফা। আমিও হেসে দেই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওঠো ওঠো, তুমি ভ্যান চালাও।’ এরপর ১ নম্বর গেটের আশপাশে একটু ঘুরে ইমামের ভ্যান চলে যায় আনুমানিক আধা কিলোমিটার দূরে প্রধানমন্ত্রীর নতুন বাড়িতে।

ভ্যান চালাচ্ছেন ইমাম শেখ।
ভ্যান চালাচ্ছেন ইমাম শেখ।

ইমামের রিকশাভ্যানে প্রধানমন্ত্রী
ভ্যানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, তাঁর স্ত্রী পেপি সিদ্দিক, তাঁদের মেয়ে লিলা তুলি সিদ্দিক ও ছেলে কায়াস মুজিব সিদ্দিক (প্রধানমন্ত্রীর কোলে)। ভ্যানে প্রধানমন্ত্রী তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কী কথা বলছিলেন? ইমাম বললেন, ‘আমি আনন্দে ও সতর্কতার সঙ্গে একমনে ভ্যানটি চালাচ্ছিলাম। যাঁরা পেছনে বসে ছিলেন, তাঁদের কথা তেমন বুঝিনি। তবে আমার পাশে প্রধানমন্ত্রী বসায় তাঁর কথা কিছু কিছু বুঝতে পারছিলাম। প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন, এই টুঙ্গিপাড়া, পাটগাতি এলাকা দিয়ে আমি প্রচুর ভ্যানে ঘুরে বেড়িয়েছি। বাড়িতে এলেই ভ্যানে চড়তাম। নামার সময় হলে প্রধানমন্ত্রী তাঁর কোলে থাকা কায়াস মুজিব সিদ্দিককে বলেন, তুমি কি আরও ঘুরবে? উত্তরে সে বলে, আমি আরও ঘুরব। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি তো এখন কিছুটা পথ হাঁটব। এ কথা বলে প্রধানমন্ত্রীসহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা ভ্যান থেকে নেমে যান।’

বাবা ও মায়ের সঙ্গে ইমাম শেখ। ছবি: আলীমুজ্জামান
বাবা ও মায়ের সঙ্গে ইমাম শেখ। ছবি: আলীমুজ্জামান

সরদারপাড়ায় বসবাস
গত ২৯ জানুয়ারি টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে ইমাম শেখের সঙ্গে দেখা হয়নি। তিনি সেদিন গিয়েছিলেন ঢাকায়। তবে মুঠোফোনে কথা হয় বেশ কয়েকবার। ৩১ জানুয়ারি গিয়ে দেখা মেলে ইমামের। টুঙ্গিপাড়ার সরদারপাড়া মহল্লায় ইমামদের বাড়ি। একটি টিনের ঘরে থাকলেও ইমামরা ভূমিহীন। একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে চৌচালা ঘর বানাচ্ছেন ইমাম শেখেরা।
ইমামের বয়স ১৮ বছর। অভাবের কারণে পড়াশোনায় বেশি দূর এগোতে পারেননি। সংসারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তি বাবা শেখ আবদুল লতিফ পেশায় একজন বর্গাচাষি। তাঁর একার রোজগারে পাঁচ ভাইবোনসহ সাতজনের এই পরিবারে সচ্ছলতা ছিল না মোটেও। বড় ভাই সাদ্দাম শেখ (২৫) সংসারের আয় বাড়ানোর জন্য রিকশাভ্যান চালানো শুরু করেন। তিন বছর আগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন বাবা। তখন এগিয়ে আসতে হয় ইমামকে। পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর পড়াশোনার পাট চুকিয়ে রিকশাভ্যান নিয়ে নেমে পড়েন জীবিকার সন্ধানে।
ইমামের মা শাহানাজ বেগম গৃহকর্মী। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ভ্যানে ওঠার এক দিন আগেও এমন প্রত্যাশা করিনি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য যা করছেন, আমরা সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’

খুশি অন্য ভ্যানচালকেরাও
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এলাকায় এসে ভ্যানে ঘুরে বেড়ানোয় খুশি স্থানীয় ভ্যানচালকেরাও। গত ২৯ জানুয়ারি দুপুরে বঙ্গবন্ধুর সমাধি কমপ্লেক্সের ১ নম্বর গেট এলাকার কয়েকজন ভ্যানচালকের সঙ্গে কথা বলে তা বোঝা যায়। শ্রীরামকান্দি গ্রামের ভ্যানচালক মো. শাহ আলম (১৯) বলেন, ‘নেত্রী ভ্যানে চড়েছেন। আমাদের দাম বেড়ে গেছে। আমরা বুঝতে পেরেছি নেত্রী আমাদের ভালোবাসেন।’
সরদারপাড়ার মো. শুকুর আলী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই প্রথম তিনি ভ্যানে উঠেছেন। এতে যে কী খুশি হইছি তা আমি বোঝাতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী তো আমাদের আফা। আমরা তাঁকে আফা বইলাই ডাকি।’ চিংগোর মহল্লার ভ্যানচালক লিটন মণ্ডল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে ছোটবেলায় দেখেছি। তিনি ভ্যানে চড়ে আমাদের গর্বিত করেছেন।’