টানটান এক কার্টুনিস্ট

আরাফাত করিম। ছবি: কবির হোসেন
আরাফাত করিম। ছবি: কবির হোসেন

আরাফাত একজন চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট। এটুকু বললে আরাফাত সম্পর্কে বলা শেষ হয় না যেন। আরেকটু বলা দরকার। এভাবে বলা যেতে পারে, আরাফাত করিম একজন মেধাবী পরিশ্রমী সম্ভাবনাময় শিল্পী। সে একই সঙ্গে একজন কার্টুনিস্ট ও কমিকস আঁকিয়েও বটে। এটুকু বললেও বলাটা কেমন যেন গতানুগতিক হয়ে যায়। এর থেকে আমি আমার মতো করে বরং ঝেড়ে কাশি। এক নম্বর কথা হচ্ছে, চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট আরাফাতের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে (গর্বের সঙ্গেই এখন বলি)। সে যে ধীরে একজন ছিপছিপে কিশোর আঁকিয়ে থেকে টান টান তরুণ শিল্পী ও কার্টুনিস্ট হয়ে উঠেছে, সেটা মোটামুটি আমি পর্যবেক্ষণ করেছি। সে আসলেই খুব মেধাবী শিল্পী। কারণ একজন কার্টুনিস্ট যখন পেইন্টিং করে, তখন তার কাজগুলোও কেমন যেন কার্টুন কার্টুন হয়ে যায়। কিন্তু আরাফাতের ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম, সে যখন কার্টুন করে, তখন কার্টুনই করে আর যখন রিয়ালিস্টিক পেইন্টিং করে, তখন পেইন্টিংই করে। তবে স্বীকার করতেই হবে, একই সঙ্গে সে একজন সুন্দর মনের মানুষও বটে, যেটা আমি মনে করি একজন শিল্পীর জন্য খুবই জরুরি। সে যে মেধাবী এবং অসম্ভব ভালো মনের মানুষ, সেটা ব্যাখ্যা করতে বরং একটা গল্প বলা যেতে পারে।
আরাফাতের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রেজাল্ট হবে বা হয়ে গেছে, এই রকম একটা সময়, আর্ট কলেজের ক্যাম্পাসে দেখা গেল সে হন্তদন্ত হয়ে তার এক বন্ধুকে খুঁজছে! শেষ পর্যন্ত সে তার বন্ধুকে খুঁজে পেল এবং সে উত্তেজিতভাবে বলল, তুই এখানে বসে আছিস, তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি।
—কেন, কী ব্যাপার?
—তোর তো ক্লাস পারসেন্টেজ নেই। স্যাররা তোকে ফেল করিয়ে দেবে।
—তো কী করব?
—স্যারদের কাছে একবার যা।
—গিয়ে লাভ নেই।
—কেন?
—আমি অলরেডি ফেল করে বসে আছি।
—বলিস কী! হতাশ আরাফাত ফেল করা বন্ধুর পাশে বসে পড়ে। ফেল করা বন্ধু (যার অবশ্য ফেল করা নিয়ে অত মাথাব্যথা নেই) আরাফাতের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোর রেজাল্টের কী অবস্থা?’ আরাফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিমর্ষ ভঙ্গিতে বলে, ‘ইয়ে...আমি তো ফার্স্ট হয়েছি!’

আরাফাতের অাঁকা কার্টুন
আরাফাতের অাঁকা কার্টুন

এই হচ্ছে আমাদের আরাফাত। শিল্পী আরাফাত করিম...কার্টুনিস্ট আরাফাত। সব সময় তাকে আমি বিমর্ষ দেখি। বিমর্ষ-বিষণ্ন এক শিল্পী নাকি কার্টুনিস্ট। কিন্তু তার কাজের দিকে তাকালে চনমন করে ওঠে মন। যে রকম তার কার্টুনে রসবোধ, স্যাটায়ার ফুটে ওঠে, সেই একই রকম তার পেইন্টিংয়ের রয়েছে আলাদা এক গাম্ভীর্য। কিছু একটা আলাদা ব্যাপার যেন আছে। টিপিক্যাল বিমূর্ত ছবি সে আঁকে না। তার ছবি রিয়ালিস্টিক। ছবিতে কীভাবে যেন সে নিজেই উপস্থিত থাকে, ‘মেটা ফিকশন’ টাইপ একটা অনুভূতি তৈরি হয় তার ছবি (বা কার্টুন?) দেখলে। আর যেহেতু তার ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টিতে কার্টুনের একটা সূক্ষ্ম পেটেন্ট আছেই, অতএব স্বীকার করতেই হবে, সেখানে ‘উইট’ ব্যাপারটাও একেবারে অনুপস্থিত নয়!
আমি একবার আমার মেজ ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিই আমাদের পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে। ভাইয়াকে বললাম, ‘ভাইয়া, আরাফাত অসম্ভব ভালো ছবি আঁকে।’
—তাই নাকি?
সে তার ছোট্ট স্কেচ বুকটা দেখে আমার মতোই মুগ্ধ হয়। এই ঘটনার পর আমার হয়েছে বিপদ। মাঝেমধ্যেই ভাইয়া ফোন দেয়, ‘আচ্ছা, ওই ছেলেটাকে পাওয়া যাবে, ওই যে খুব সুন্দর স্কেচ করে...আরাফাত? তাকে দিয়ে কিছু ছবি আঁকাতাম আমার বইয়ের? সে কি করবে?’ আমি আমতা আমতা করি। আরাফাত করিম এখন প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক পাওয়া শিল্পী, তাকে ধরা এখন মুশকিল আছে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ায় সে এই পদক পায়।
তবে না, আমাদের আরাফাত এখনো সেই আগের মতোই আছে নিরহংকার চুপচাপ বিমর্ষ বিষণ্ন এক শিল্পী ও কার্টুনিস্ট। আমার মনে হয়, সব সময় সে কিছু একটা ভাবছে। কী ভাবে? হয়তো কোনো একটা বিশাল শূন্য ক্যানভাস নিয়ে সে ভাবে, যেখানে সে নিজের স্টুডিওতে ফিরে গিয়েই এঁকে ফেলবে অসম্ভব কোনো ছবি, যা দেখে আমরা আবার চমকে উঠব, স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠব, ‘বাহ্! কী সুন্দর!’ সেটা হতে পারে কোনো কার্টুন, পেইন্টিং হতেই বা বাধা কোথায়, সে তো দুটোতেই সমান দক্ষ।
লেখক: কার্টুনিস্ট