নাজমুল হকের হাজার দোয়াত

নিজের সংগ্রহের সামনে নাজমুল হক। ছবি: লেখক
নিজের সংগ্রহের সামনে নাজমুল হক। ছবি: লেখক

দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ল কেবল দোয়াত আর দোয়াত। কোথায় নেই—শোকেস, তাক, বাক্স, ট্রাঙ্ক। ঘরময় সাজিয়ে রাখা হয়েছে এই দোয়াত বা কালি রাখার পাত্র। এগুলোর আকার-আকৃতিও চোখে পড়ার মতো। হাতি, আম, কামরাঙা, ব্যাঙ কত আকার-প্রকারের যে দোয়াত। ঢাকার পল্লবীর এই বাড়িটির মালিক নাজমুল হক। একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ছোটবেলায় কলমের সঙ্গে দোয়াতও নিয়ে যেতেন পাঠশালায়। এখন আর দোয়াত-কলমের চল নেই। কিন্তু নাজমুল হক শখের বশেই সংগ্রহ করেছেন এমন হাজারো দোয়াত।

ছোট্ট কলসিই কালির দোয়াত আর পালকের কলম
ছোট্ট কলসিই কালির দোয়াত আর পালকের কলম

তাঁর দোয়াতগুলো যেন বাংলার কয়েক শ বছরের শিক্ষার ইতিহাসের কথা জানান দেয়। কিছু দোয়াতের ওপরের দিকে তিন-চারটি শিকল ঝোলানোর ব্যবস্থা আছে। সেই সময়ের অভিজাত পরিবারের ছেলেমেয়েরা দোয়াত হাতে ঝুলিয়ে পাঠশালায় যেত। আছে ১৮০০ সালের আগেকার দোয়াত। তখন কলম ছিল কাঠের ও পালকের। সামনে কালির দোয়াত রেখে সেটায় ডুবিয়ে লিখতে হতো। একটু লেখার পরই আবার কলম ভেজানো হতো দোয়াতে।

পিতলের এই হাতির দোয়াতের ওজন তিন কেজি
পিতলের এই হাতির দোয়াতের ওজন তিন কেজি

নাজমুল হকের সংগ্রহে আছে তামা, পিতল, কাঁসা, সিসা, দস্তা, জার্মান সিলভার, ক্রিস্টাল, কাচ, সিরামিক, শ্বেতপাথর, মার্বেল পাথর ও স্টিলের দোয়াত। আছে মাটির দোয়াতও। মূল্যবান সংগ্রহের একটি হচ্ছে রুপার দোয়াত। সঙ্গে একটি রুপার কলম। মজার বিষয় হলো বেশির ভাগ দোয়াতই বিশেষ কায়দায় তৈরি, দোয়াত কাত হয়ে পড়ে গেলেও তা থেকে কালি পড়বে না। দোয়াতগুলো নানা গড়নের। কোনোটা দেখতে গোলাকার, কোনোটা চারকোনা। ছয়কোনা আর হৃদয়াকৃতির দোয়াতও আছে এখানে। কলসি, হাঁড়ি, বাক্সের মতো দোয়াতও রয়েছে। প্রতিটি দোয়াতের গায়ে কিছু না কিছু নকশা আছে। ফুল, লতা, পাতার নকশাই বেশি।

চিনামাটির দোয়াত
চিনামাটির দোয়াত

শুরুর কথা
‘১৯৮৩ সালে মুদ্রা সংগ্রহ দিয়ে আমার সংগ্রহের যাত্রা শুরু হয়। শৈশব কেটেছে পাবনায়। প্রথমে মুদ্রা সংগ্রহের শখ পেয়ে বসে আমাকে। একদিন কাঁসারির দোকানে মুদ্রা কিনতে গিয়েই চোখে পড়ে ল্যাম্পের মতো একটি বস্তু। দোকানি জানালেন, এটি হচ্ছে দোয়াত। পিতলের এমন দোয়াত আগে কখনো দেখিনি। কিনতে চাইলে দোকানি বেচবেন না বলে জানান। অনেক বুঝিয়ে সেই দোয়াতটি কিনে আনি পাঁচ টাকা দিয়ে।’ এরপর থেকেই লেখার কালি রাখার দোয়াত সংগ্রহের শখ পেয়ে বসে নাজমুল হককে।

কারুকাজ করা কলম ও দোয়াত
কারুকাজ করা কলম ও দোয়াত

১৯৭৭ সালে তাঁর নিজের ভারতীয় মুদ্রার বড় একটি সংগ্রহ প্রদর্শিত হয় পাবনা শিল্প মেলায়। পরে একটি মেলায় মুদ্রাসহ মাত্র দুটি দোয়াত প্রদর্শন করেন তিনি। এখন সব মিলিয়ে তাঁর সংগ্রহে আছে হাজারেরও বেশি দোয়াত। এর মধ্যে ধাতব দোয়াত রয়েছে প্রায় ৩০০-এর মতো, কাচের ৩০০ দোয়াত। ব্রোঞ্জের দোয়াত রয়েছে, যেটা ৩০০ বছরের পুরোনো সুলতানি আমলের।

নানা আকারের দোয়াত
নানা আকারের দোয়াত

তাঁর কাছে আছে সবচেয়ে ছোট দোয়াত, আবার সবচেয়ে বড় প্রায় ৩ কেজি ওজনের পিতলের হাতি আকৃতির দোয়াত। রয়েছে ৫০ গ্রাম এবং সর্বোচ্চ ১০ কেজি ওজনের দোয়াত। তাকে সাজানো রয়েছে ম্যাজিক দোয়াত, যা পড়ে গেলেও কালি বের হবে না।
ব্যবসার ফাঁকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন মূল্যবান এই সংগ্রহ। মিরপুরের পল্লবীতে নিজের বাড়ির একটি ঘর সাজিয়েছেন জাদুঘরের আদলে। শিক্ষাবিষয়ক জাদুঘর গড়তে চাইলে নাজমুল হক সহায়তা করবেন বলে জানিয়েছেন। দোয়াত ছাড়াও তাঁর সংগ্রহে আছে নানা রকম কলম ও দুষ্প্রাপ্য কিছু পুঁথি। আরও আছে মুদ্রা, শিলালিপি, দেশলাই, সিঁদুরের কৌটা, পিতলের ম্যাচ বাক্স, হুঁকাসহ প্রায় ৩১৪টির মতো নিদর্শন। সব মিলিয়ে বাড়িটা যেন জাদুঘরের এক খুদে সংস্করণ।