পরিবার পরিকল্পনা জনগণের ক্ষমতায়ন জাতির উন্নয়ন

তবে এ অবস্থায় পৌঁছাতে তাঁর যে পথচলা, তা মোটেও মসৃণ ছিল না। মৌলভীবাজারের এই নারীর বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৬ বছর বয়সে। বিয়ের সময় বা এরপরও জোবায়েদা জানতেনই না পরিবার পরিকল্পনা কী বা কীভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। পরিবার পরিকল্পনা–সংক্রান্ত কোনো সেবা পাওয়া তো দূরের কথা,গর্ভাবস্থায়ও তিনি কোনো সেবা পাননি। আর এর পরিণতি হয়েছে খুব খারাপ। জোবায়েদার প্রথম সন্তানটি জন্মের সময়ই মারা যায় দীর্ঘসময় ধরে প্রসবব্যথার কারণে, আর এর ফলে তিনি আক্রান্ত হন প্রসবজনিত ফিস্টুলায় (অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা)।  

আজ জোবায়েদা একজন সফল ব্যবসায়ী। সিমেন্টের বস্তা বানিয়ে বিক্রি করেন। ছোট ব্যবসা। তাতে কী ? এই ব্যবসা করেই তো তিনি আজ স্বাবলম্বী। তিনি ও তাঁর স্বামী এখন নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারে সচেতন এবং নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি বেছে নিতে পারেন। ফিস্টুলা চিকিৎসা শেষে জোবায়েদা বর্তমানে একজন ফিস্টুলা অ্যাডভোকেটও।

জোবায়েদা হলেন বাংলাদেশের লাখো নারীর একজন, যিনি প্রমাণ করেছেন পরিবার পরিকল্পনায় বিনিয়োগ করার মানে নারী ও দম্পতিদের স্বাস্থ্য ও অধিকারের জন্য বিনিয়োগ করা। এই বিনিয়োগের ফলে জোবায়েদার পক্ষে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। একজন ব্যক্তি কখন বিয়ে করবে এবং পরিবারের আকার কী হবে, তা নিয়ে পরিকল্পনা করা তাঁর অধিকার।

জোবায়েদার দ্বিতীয় সন্তান হয় তাঁর ফিস্টুলা অপারেশনের পর। বর্তমানে তাঁর বয়স সাত বছর। জোবায়েদার ইচ্ছা, এই সন্তানটিকে তিনি শিক্ষিত করবেন এবং আর কোনো সন্তান নেবেন না।  জোবায়েদা বলেন, ‘ আমার যা আয়, তাতে আরেকটা বাচ্চাকে পুষ্টিকর খাবার, পড়াশোনা ও উচ্চশিক্ষা দিয়ে মানুষ করা সম্ভব নয়। আমি একটি সন্তানকেই মানুষের মতো মানুষ করতে চাই। এ জন্য আমরা স্বামী– স্ত্রী নিজেদের পছন্দমতো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছি।’

পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের সফলতার জন্য বাংলাদেশ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। একটা সময় যখন একটি দেশ সদ্য যুদ্ধের বিভীষিকা পেরিয়ে দারিদ্র্যের মোকাবিলা করছে, তখন ভগ্ন অবকাঠামো এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়ায়। সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করবে, তা ধারণা করা কঠিন ছিল। বাংলাদেশে মোট প্রজনন হার ১৯৭৪ সালে ৬ দশমিক ৩ ছিল যা ১৯৯৪ সালে ৩ দশমিক ৪-এ নেমে আসে। আর ২০১১ সালে এই হার ২ দশমিক ৩-এ দাঁড়ায় যা গত কয়েক বছর ধরে থমকে আছে। এখন বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি নানাভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার বৈশ্বিক পরিবার পরিকল্পনা বা ‘ফ্যামিলি প্ল্যানিং ২০২০’ উদ্যোগে শামিল হওয়ার অঙ্গীকার করে এবং কয়েকটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে, যা ২০২০ সালের মধ্যে অর্জন করা হবে। চলতি বছরের জুলাইয়ে লন্ডনে অনুষ্ঠেয় এক সম্মেলনে কর্মসূচির অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে এবং পরবর্তী বাধাগুলো যাচাই করে দেখা হবে। কারণ, এসব বাধা ‘এফপি ২০২০’ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত করার পাশাপাশি বৃহত্তর পর্যায়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণেও বিঘ্ন ঘটাতে পারে। কিছু বাধা থাকলেও সেগুলো এমন নয় যে দূর করা অসম্ভব। দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার, পরিবার পরিকল্পনায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য কার্যকরী কৌশল উদ্ভাবন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সেবা পৌঁছানোর মাধ্যমে দেশটির পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের লক্ষ্য অর্জন করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য ‘ফ্যামিলি প্ল্যানিং ২০২০’-এর লক্ষ্যমাত্রাসমূহ:

l মোট প্রজনন হার ২   

     দশমিক শুন্যে নামিয়ে আনা।

l গর্ভনিরোধক ব্যবহারকারীর হার   

     (সিপিআর) ৬২ শতাংশ থেকে 

     ৭৫ শতাংশে উন্নীতকরণ।

l দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ

     পদ্ধতি গ্রহণের হার ৮.১ 

     শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০

     শতাংশে উন্নীতকরণ।

l   পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ     

     চাহিদা ১২ শতাংশ থেকে ১০

     শতাংশে নামিয়ে আনা।

l জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি   

     গ্রহণকারীদের ঝরে পড়ার হার

     হার ৩০ শতাংশ থেকে ২০

     শতাংশে নামিয়ে আনা।

আমাদের দেশে দেখা যায়, জোবায়েদার মতো অল্পবয়সী মেয়ে ও নারীরা প্রয়োজনের তুলনায় পরিবার পরিকল্পনা-সেবা কম পান। তাঁদের কাছে এই সেবা পৌঁছে দেওয়া জরুরি। বর্তমানে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী দম্পতিদের মাত্র ৫১ শতাংশ পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যা জাতীয় গড় হারের (৬২ শতাংশ) তুলনায় অনেক কম। বিবাহিতা কিশোরীদের পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত সেবা থেকে বঞ্চিত থাকার হার সবচেয়ে বেশি। আর সেটা ১৭ শতাংশ, যা জাতীয় গড় হারের (১২ শতাংশ) তুলনায় অনেক বেশি। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির অংশ হিসেবে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সবার সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। তাই বিষয়টিকে শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

যেসব নারী সম্প্রতি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা-সেবা না পৌঁছানোর হার বেশি। গত দুই বছরের মধ্যে যাঁরা সন্তান প্রসব করেছেন, তাঁদের ৪৪ শতাংশের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী পৌঁছায় না। এটা জাতীয় গড় হারের (১২ শতাংশ) তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি। তবে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা পেতে স্বাভাবিকভাবেই স্বাস্থ্যকর্মীদের সংস্পর্শে থাকার কথা। সুতরাং এ সময়ে প্রসব পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্িচত করা প্রয়োজন।

পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের অংশীদার হিসেবে পুরুষদের আরও বেশি সক্রিয় করা প্রয়োজন। আধুনিক জন্মনিরোধক পদ্ধতিগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অনুপাত ১: ৬ (পুরুষ: ৭.৬ শতাংশ, নারী: ৪৬.৫ শতাংশ)। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ যে প্রক্রিয়ায় পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মীদের ব্যবহার করে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নারীদের সেবা পৌঁছে দিয়েছে, তা একটি সফল কৌশল হিসেবে চিহ্নিত। তবে আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা হলো, এই কৌশল মাঠপর্যায়ে কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি বাড়ানোর পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রিক ভার প্রাথমিকভাবে নারীদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে। এভাবে কেবল নারীদের ব্যবহারোপযোগী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার বেড়েছে এবং পুরুষদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে অংশীদার করার পরিকল্পনা সঠিক গতিশীলতা পায়নি।।

জন্মনিরোধক ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অসমতা দূর করতে অনেক কিছু করার আছে। পূর্বাঞ্চলে (সিলেট ও চট্টগ্রাম) মানুষের সন্তানের চাহিদা বেশি। সেখানে পরিবার পরিকল্পনা-সেবা পৌঁছানোর সুযোগ কম থাকায় গর্ভনিরোধক ব্যবহারের হার কম এবং জন্মহার বেশি। নেপথ্যের কারণগুলো যাচাই-বাছাই করে সমাধান দেওয়াটা সহজ  নয়। এ কারণে ওই অঞ্চলে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না।

জন্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ী পদ্ধতিগুলোর ব্যবহার বাড়ানো দরকার। স্বল্পমেয়াদি পদ্ধতিগুলোর ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতার কারণে ঝরে পড়ার হার বেশি। মাত্র ৮ শতাংশ নারী দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ী পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এটা একটা জটিল সমস্যা। কারণ, গড়পড়তা বাংলাদেশি নারীরা ২৫ বছর বয়সে পৌঁছানোর আগেই পরিবারের কাঙ্ক্ষিত আকৃতি নির্ধারণ করে নেন। আর জীবনের অবশিষ্ট প্রজননক্ষম বছরগুলোয় গর্ভধারণ এড়িয়ে চলেন। স্বল্পমেয়াদি পদ্ধতিগুলো সঠিকভাবে ব্যবহৃত না হলে অথবা অনিয়মিত ব্যবহৃত হলে সেগুলোর ওপর নির্ভরতাকে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভাবস্থা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রতিবছর এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের সংখ্যা প্রায়  ১৩ লাখ।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন দুটি অধিদপ্তর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে কার্যকরী সমন্বয়ের দুর্বলতার কারণে সামগ্রিক সেবা প্রদানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করছে।  নারীদের জন্য একই সেবা প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ প্রসব, পরিবার পরিকল্পনা ও সামগ্রিক প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা পাওয়ার সুযোগ থাকা জরুরি। দুটি বিভাগের সমন্বয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিপুলসংখ্যক নারী সন্তান প্রসব করার পরবর্তী সময়ে তাঁদের পরিবার পরিকল্পনা-সেবা দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। তা ছাড়া সেবাকর্মীদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পদ খালি রয়েছে অথবা কর্মীরা অনুপস্থিত থাকেন। দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন গর্ভনিরোধক ব্যবহারের পদ্ধতি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের আওতাধীন চিকিৎসক থেকে শুরু করে অন্যান্য সেবা প্রদানকারীদের কাজের শৃঙ্খলা বহাল রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের সেবার গুণগত মানও বজায় রাখতে হবে। মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য এটা জরুরি।

শহরাঞ্চলে সমন্বিত, মানসম্মত ও উপযোগী পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সেখানকার জনগণের জন্য পরিবার পরিকল্পনা-সেবার ক্ষেত্রে একটি বড় শূন্যতা পূরণ করবে, বিশেষত বস্তি এলাকাগুলোয়।   

  শহরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়াটা স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের কর্তব্য। তারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবার পরিকল্পনা-সেবা গুটিকয়েক বস্তিতে এনজিওগুলোর মাধ্যমে পৌঁছে দেয়; কিন্তু এসব সেবা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বস্তিবাসীদের জন্য বিনা মূল্যে পরিবার পরিকল্পনা সেবাদানের প্রয়োজনীয়তা অনেক।

বাংলাদেশকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে হলে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি ঢেলে সাজাতে হবে। এর জন্য সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করেই এ কর্মসূচি আরও বেগবান করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা-সেবা পৌঁছানোর সামগ্রিক কৌশল উন্নত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে সেবা পৌঁছানো পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ, অত্যন্ত পারদর্শী জনবল নিয়োগ করতে হবে। আরও বেশি গুরুত্বসহকারে পরিদর্শন, তথ্য সংগ্রহ ও প্রদান এবং তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করার পাশাপাশি সেবার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে অধিকতর নজর রাখতে হবে। কিশোরী, নারী ও প্রসূতি এবং দেশের পূর্বাঞ্চলের জনগণের কাছে প্রয়োজনীয় পরিবার পরিকল্পনা-সেবা না পৌঁছানোর কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। এসব মানুষকে পরিবার পরিকল্পনা-সেবা দিয়ে সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া নিশ্চিত করতে হলে সমস্যাগুলোকে অবশ্যই বুঝতে হবে।

জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীসমূহ সংগ্রহ ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বাড়তি নজর দেওয়া দরকার। তা ছাড়া জাতীয় পর্যায়ে নীতিমালা ও কৌশল নির্ধারণের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। এতে করে একটি অধিকতর কার্যকর পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির জন্য সহায়ক পরিবেশ মিলবে। আর এভাবেই দেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সাফল্যের নতুন যুগে প্রবেশের পথ সুগম হবে।

ইউএনএফপিএর একটি প্রতিবেদন থেকে অনূদিত