ভূরুঙ্গামারী থেকে আফ্রিকা

মূল রচনা: নিজে বড় হয়েছেন দুর্যোগ আর অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম করে। সেই মাহমুদুল ইসলাম কীভাবে দাঁড়ালেন আফ্রিকার দুর্গত মানুষের পাশে?

দক্ষিণ সুদানের দুর্যোগমন্ত্রী আওয়াট ডেঙ্গ আচুইলের হাত থেকে বিশেষ সম্মাননা নিচ্ছেন মাহমুদুল ইসলাম
দক্ষিণ সুদানের দুর্যোগমন্ত্রী আওয়াট ডেঙ্গ আচুইলের হাত থেকে বিশেষ সম্মাননা নিচ্ছেন মাহমুদুল ইসলাম

মাহমুদুল ইসলামের জন্ম ও বেড়ে ওঠা দেশের সুদূর উত্তরের এক গ্রামে। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বাঁশজানি গ্রাম। দেশের প্রায় শেষ মাথার এই গ্রামের দক্ষিণ বাঁশজানি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে মাহমুদুল ইসলাম ভর্তি হন ভূরুঙ্গামারী পাইলট হাইস্কুলে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় তাঁর কেন্দ্রে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার খবর নিয়ে মাহমুদুল বাড়ি ফিরেছিলেন খুশি মনে। শিক্ষক বাবা আজিজুর রহমান ছেলের সাফল্যে খুশি হয়েছিলেন ঠিক, কিন্তু ছেলেকে এ-ও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত আরও বড়। সেদিন ছেলেকে তিনি বলেছিলেন, ‘মাস্টার্স পাস করে মানুষের মতো মানুষ হবি—এটাই আমার চাওয়া।’ মাহমুদ তাঁর বাবার কথা রেখেছেন। এখন তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ।দক্ষিণ সুদানের দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের প্রধান পরামর্শক।
মাহমুদের এ পর্যায়ে উঠে আসার সংগ্রামের গল্পই চলুন শুনি।

আফ্রিকায় প্রথম মিশন: কাজের টানে ইথিওপিয়ার পথে-প্রান্তরে ঘুরেছেন মাহমুদুল ইসলাম
আফ্রিকায় প্রথম মিশন: কাজের টানে ইথিওপিয়ার পথে-প্রান্তরে ঘুরেছেন মাহমুদুল ইসলাম

ফুলকুমার আর দুধকুমারের পাড়ে
গ্রামের দুই পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে দুটি নদ। ফুলকুমার আর দুধকুমার। ফি বছরের বন্যা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকত গ্রামে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই আর দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষের কষ্ট অন্তর দিয়ে বোঝাটা হয়তো সেখান থেকেই পেয়েছিলেন মাহমুদ। কে জানত অভাব আর দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে ওঠা মাহমুদুলইসলাম একদিন সুদূর নীল নদের তীরের দেশ ইথিওপিয়া আর দক্ষিণ সুদানের মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন, তাঁদের ভালোবাসা পাবেন।

সহকর্মীর সঙ্গে
সহকর্মীর সঙ্গে

মাহমুদুলইসলামের জন্ম ১৯৬৪ সালে।রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ করে মাহমুদ পিএইচডি করতে যান মালয়েশিয়ায়। সেখানে নিজ খরচে কিছুদিন পড়ালেখা চালাতে হয় তাঁর। এরপর মালয়েশিয়া সরকারের কারিগরি সহযোগিতা বৃত্তিটা পেয়ে যান। কীভাবে পামের শিল্পবর্জ্য থেকে ব্যবহারোপযোগী দ্রব্য উৎপাদন করা যায়, সেটাই ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়। এরপর জাপানে ওই শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার সুযোগ পান।
দেশে ফিরে মাহমুদুল যোগ দেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় (এফএও)। এখানে গ্রামের মানুষের বন্যাসহ নানা ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলার ওপর কাজ করেন। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিতে (সিডিএমপি) কাজ করে আরও বেশি দুর্গত মানুষের পাশে থাকার সুযোগ পান মাহমুদুল।
২০০৯ সালে নরওয়ে সরকারের হয়ে ইথিওপিয়া সরকারের দুর্যোগবিষয়ক পরামর্শকের দায়িত্ব নেন তিনি। আফ্রিকার দরিদ্র এই দেশে গিয়ে তিনি কাজে লাগালেন তাঁর ফেলে আসা সেই গ্রামের অভিজ্ঞতা।
কীভাবে গ্রামের মানুষের বন্যা, খরা আর অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কষ্ট দূর করা যায়, সেই কৌশল সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছে দেন তিনি। ইথিওপিয়ার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ চালু করার জন্য নরওয়ে সরকারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পরামর্শ দেন মাহমুদুল। ইথিওপিয়ার ডার ও আদামা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ বিষয়ে কারিকুলাম তৈরি এবং কোর্স চালু হয় তাঁর নেতৃত্বে। আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্যোগ বিষয়ে একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয় তাঁর হাত দিয়েই।
মিশন দক্ষিণ সুদান
মাহমুদুলের বর্তমান মিশন মধ্য আফ্রিকার দেশ দক্ষিণ সুদানে দুর্যোগ ঠেকানোর। এই দেশের রাজধানী জুবা এখন তাঁর ঠিকানা। বসেন দেশটির দুর্যোগমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশেই একটি কক্ষে। থাকেন কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত রাজধানী জুবার কূটনৈতিক এলাকায়। তিনি এখন দক্ষিণ সুদানের জেন্ডার, মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের প্রধান পরামর্শক।
সে দেশের সরকারের দুর্যোগবিষয়ক নীতিকাঠামো তৈরি ও উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনবলতৈরিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন তিনি। দুর্যোগ ঠেকাতে বা দুর্যোগ-পরবর্তী অবস্থা সামাল দেওয়ার পরিকল্পনা প্রণয়নও করেন মাহমুদ।তিনি বলছিলেন, ‘নিজের কাজকে কেবল নথি আর প্রতিবেদন তৈরির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখিনি। আমি চলে আসার পরে যাতে সেসব দেশের নতুন প্রজন্ম এ কাজের দায়িত্ব নিতে তৈরি হয়, সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে কাজ করি।’
দায়িত্ব নেওয়ার পর মাহমুদ প্রথমে জাতিগত দ্বন্দ্ব আর যুদ্ধবিধ্বস্ত দক্ষিণ সুদানের প্রায় পুরোটা ঘুরে বেড়ান। সে দেশের রাজনৈতিক দুর্যোগের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। প্রণয়ন করেন সে দেশের জাতীয় দুর্যোগবিষয়ক নীতিমালা, দুর্যোগে ঝুঁকি হ্রাসবিষয়ক জাতীয় প্ল্যাটফর্ম।
ভিনদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সফল হয়েছেন, পেয়েছেন দক্ষিণ সুদান সরকারের সম্মাননাও।তার পরও তৃপ্ত নন মাহমুদুল ইসলাম। বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি কাজ করার ইচ্ছে সব সময়। তাঁর মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশ অনেক সাফল্য পেয়েছে। আফ্রিকার দেশগুলো বাংলাদেশের সেসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দুর্যোগের ক্ষতি কমিয়ে আনতে পেরেছে। তবে বাংলাদেশের সাফল্যকে ম্লান করে দিতে পারে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। দক্ষিণ সুদান তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।
মাহমুদুল ইসলাম তাই বিশ্বাস করেন, শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার পূর্বপ্রস্তুতি নিলেই মানবিক বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না, রাজনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

বিদ্রোহীদের কবলে
বিদ্রোহীদের কবলে

বিদ্রোহীদের কবলে
দক্ষিণ সুদানের মতো জায়গায় কাজ করাটা কখনো সহজ ছিল না। বহুবার পড়েছেন বিপদের মুখে। একবার তো খোয়াতে বসেছিলেন জীবনটাই। ঘটনা এ রকম—
১৬ ডিসেম্বর ২০১৩। ভোর চারটায় নরওয়ে রিফিউজি কাউন্সিলের দক্ষিণ সুদানের কান্ট্রি ডিরেক্টরের খুদে বার্তা পেয়ে মাহমুদুল ইসলামের ঘুম ভাঙে। ‘রাজধানী জুবার চারপাশে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়েছে। নরওয়ে সরকারের সব কর্মীকে যার যার স্থানে অবস্থান করতে হবে।’ এই জরুরি বার্তা পেয়ে ই-মেইল ও স্কাইপের মাধ্যমে জুবায় থাকা সব বন্ধু এবং সহকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন তিনি।
ক্ষমতাসীন সাউথ সুদান রুলিং পার্টির সঙ্গে বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ভোর ছয়টায় বাসার ছাদে গেলে গোলাগুলি ও বোমার শব্দ আরও স্পষ্ট হলো। এবার চোখের সামনেই গুলি আর বোমার আগুন দেখতে পেলেন। মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলে কেউ ফোন ধরলেন না। খানিক পর জানানো হলো, মহাসড়ক আর মন্ত্রণালয়গুলো সরকারের সামরিক বাহিনীর দখলে আছে। দ্রুত বাসা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হতে বলা হলো মাহমুদুলসহ সবাইকে। সবকিছু নিয়ে দুই দিন ঘর বন্ধ করে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। বাইরে যাওয়া নিষেধ। কিছুক্ষণ পর পর গুলি-বোমার শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠছিল। মাহমুদুলের মনে পড়ছিল ১৯৭১ সালের কথা। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে তাঁদের গ্রাম তছনছ হয়ে গিয়েছিল। ভূরুঙ্গামারী সদরে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল তাদের পরিবার। কোনোমতে জীবন বেঁচেছিল তাঁদের। সুদূর আফ্রিকার এই দেশে এসে কি জীবন খোয়াবেন? নানা আশঙ্কায় দুটো দিন গেল।
১৮ ডিসেম্বর শুকনো খাবার, পানি আর জরুরি কাগজ নিয়ে মাহমুদুল ও তাঁর সহকর্মীরা সেনা প্রহরায় জুবা ছাড়লেন। ‘কাঁধে ভারী ব্যাগ। সেনাবাহিনীর গাড়িতে চড়ে আমরা যাচ্ছি। কোথায় জানি না। কী হবে জানি না। শেষ পর্যন্ত আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের ৪০ জন সহকর্মীকে নিয়ে জুবা বিমানবন্দরে পৌঁছাই। বিমান যখন কেনিয়ার নাইরোবি বিমানবন্দরে পৌঁছাল, তখন যেন জানে পানি পেলেন সবাই।’ বলছিলেন মাহমুদুল ইসলাম।
নাইরোবিতে এক দিন অবস্থানের পর মাহমুদুল ইসলামসহ দক্ষিণ সুদানের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করা ২৫ জনের মতো বাংলাদেশি ২০ ডিসেম্বর ঢাকায়ফিরে আসেন। পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার তাঁরা জুবায় ফিরবেন। প্রাকৃতিক, না রাজনৈতিক—কোন দুর্যোগে মানুষের ক্ষতি বেশি হয়, সেই বিতর্কে না গিয়ে মাহমুদুল শুধু একটি বিষয়ই এখন ভাবছেন—যুদ্ধ শেষে একদিন আফ্রিকার ওই ছোট্ট দেশে শান্তি আসবে। রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে দক্ষিণ সুদানের মানুষ একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে। আর সেই কাজে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারলেই খুশি মাহমুদুল ইসলাম।