পৃথিবীর মা

মাদার তেরেসা (জন্ম: ২৬ আগস্ট ১৯১০—মৃত্যু: ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭)। ১৯৮১ সালে ছবিটি ঢাকায় তোলা। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
মাদার তেরেসা (জন্ম: ২৬ আগস্ট ১৯১০—মৃত্যু: ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭)। ১৯৮১ সালে ছবিটি ঢাকায় তোলা। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

গতকাল ৫ সেপ্টেম্বর ছিল মাদার তেরেসার মৃত্যুদিন। তাঁকে নিয়ে এই বিশেষ লেখা।

‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় দাঙ্গা হচ্ছে। অভাব আর দারিদ্র্যে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। অস্থিরতা। খাদ্যসংকট। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমি ত্রাণ গ্রহণ করা শুরু করি। তেমন সময় চার বছরের এক শিশু তার বাবাকে নিয়ে আসে আমার কাছে। শিশুটির হাতে একটা টিনের কৌটা। তার বাবা আমাকে বলল, সে এক মাস দুধে চিনি না খেয়ে এই কৌটায় জমা করেছে আপনাকে দেবে বলে। ছোট্ট হাত আমাকে টিনের কৌটা দিয়ে চলে গেল। তখন আমাকে ভাবতে হলো, সামান্য কিছু অসামান্য হতে পারে। এমন অনেক অভিজ্ঞতা আমার আছে। শুধু ভালোবাসা দিয়ে দুস্থ মানুষের সেবা করা যায়। এর চেয়ে বড় সেবা আর কিছু হতে পারে না...।’ কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। উন্মুক্ত অনুষ্ঠানটি হয়েছিল কলা ভবনের পশ্চিমে। দর্শকশ্রোতারা সেদিন দুলে উঠেছিলেন এই মহীয়সী কিংবদন্তি নারী মাদার তেরেসার বাণী শুনে। এত দরদ দিয়ে কেউ এমন কথা বলে না। নতুন করে তিনি যেন বিশ্ববাসীকে ভালোবাসার সংজ্ঞা দিয়ে গেলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘মানুষ বুঝতে পারে না ভালোবাসাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পৃথিবীতে ভালোবাসার অভাব দেখা দিয়েছে। এটি বিলুপ্ত হয়ে গেলে মানবসভ্যতার ভরসার জায়গা থাকল না!’

তিনি স্টেজে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে বলছেন, আমরা শুনছি। যখন দারিদ্র্যপীড়িত মানবদের সেবার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, অনেকের চোখে তখন অশ্রু। অবলীলায় তাঁর জবানবন্দি যেন শুনতে পাচ্ছে আমার ক্যামেরাও। ওয়ান টোয়েন্টি ইয়াসিকা বক্স ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারের পুরোটা জুড়ে পৃথিবীর মা, কলকাতার মাদার তেরেসা।

আমি একজন আলোকচিত্রশিল্পী, ভুলে গিয়ে মজে রইলাম দর্শকে। যখন মাইকের সামনে এই নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বক্তৃতা করছিলেন, তাঁর সমস্ত স্নায়ুতন্ত্র কোনো মানবতাবাদী মহৎ শিল্পকর্মের ড্রয়িংয়ের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে বেদনার এক শ্রুতচিত্র এঁকে দিচ্ছিল। এই বিরল দৃশ্য দেখে দিল কাঁপে না কার! যখন বলছেন, পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে ভালোবাসার অভাব, তাঁর বুজে থাকা চোখ, হাত ও আঙুলের ইশারায় কম্পমান পবিত্র দেহ একাকার হয়ে যায়। কম্পমান আমিও ক্যামেরার শাটারে চাপ দিই—মুখাবয়ব ও কপালের ভাঁজ দেখে পৃথিবীর সব ভাষায় যেন তাৎক্ষণিক অনুবাদ করা যায়। বিপুল করতালির মধ্যে বক্তৃতা এমন এক সিম্ফনি সৃষ্টি করল, আজও তা হৃদয়ে বন্দী হয়ে আছে। বক্তৃতা শেষে স্টেজে উঠে গেলাম। আমার অটোগ্রাফ খাতায় লিখলেন তিন লাইন ভালোবাসার কথা। আমার তোলা একটা সাদা–কালো পোর্ট্রেট প্রিন্ট করে রাখা ছিল আমার ব্যাগে, তাতেও স্বাক্ষর দিলেন।

মাত্র ১৯ বছর বয়সে মাদার তেরেসা ভারতবর্ষে আসেন। ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট মেসিডোনিয়ায় তাঁর জন্ম। ১৯৯৭-এর ৫ সেপ্টেম্বর কলকাতায় চিরদিনের মতো চোখ বুজলেন তিনি। ১৯ বছর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের সেবায় ত্যাগ ও আনন্দের সঙ্গে উৎসর্গ করে গেছেন নিজেকে। পুরস্কার পেয়েছেন ৩২৪টি। ১৯৭৯-এর ডিসেম্বরে নোবেল শান্তি পুরস্কার, ১৯৯৭-এর জুনে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল’ এবং এর আগে ভারত সরকারের সবচেয়ে বড় বেসামরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ প্রদান করা হয় তাঁকে। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রধান পোপ ফ্রান্সিস ২০১৬-এর ৪ সেপ্টেম্বর ভ্যাটিকান সিটিতে মাদার তেরেসাকে ‘সেন্ট’ ঘোষণা করেন।

১৯৮১ সালের ১৮ জানুয়ারি শান্তির দূত মাদার তেরেসা ঢাকায় আসেন। আমি আগেই জেনে নিই ঢাকায় তাঁর অবস্থান। যথাসময়ে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের একটি চার্চে গিয়ে হাজির হই। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল না আমার। চার্চের গেটে ক্যামেরা হাতে অপেক্ষা করছি। গেটের সামনে সাদা মাইক্রোবাস নোবেল বিজয়ীকে নিয়ে রওনা হবে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে। মিশনারিজ অব চ্যারিটির অফিস আছে সেখানে। কিছুক্ষণ পরপর আমাদের দেশীয় নানরা গেটের বাইরে ক্যামেরা হাতে আমাকে দেখে চলে যান। তাঁরা আমাকে কয়েকবার বলে গেলেন, মাদার এক্ষুনি বের হবেন, আমি যেন এখান থেকে সরে যাই।

প্রায় দেড় ঘণ্টা পর চার্চের বড় গেটটি খুলে গেল। বেরিয়ে এলেন মাদার তেরেসা, পেছনে তিনজন দেশীয় নান। তাঁরা বিরক্ত, সরে যেতে বলছেন আমাকে। অসহায় আমি ছবি তোলার কথা বলতেই মাদার দ্রুত হেঁটে সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন দরজা খোলা মাইক্রোবাসের দিকে। প্রায় দৌড়ে আমি তাঁর গতি রোধ করলাম। দুই হাত প্রসারিত করে আটকে দিলাম গাড়ির দরজা। সবাই আমাকে শনাক্ত করলেন বেয়াদব বলে। হতভম্ব এবং বিরক্ত মাদার তেরেসা। আমি ছাড়ব না এমন অবস্থায় মাদার আমাকে বললেন, ‘মাত্র পাঁচ মিনিট, এর মধ্যে শেষ করতে হবে।’

দ্রুত হাঁটা ধরলেন তাঁরা। তিনজন নান মাদার তেরেসার পেছনে, সঙ্গে আমি। আমাদের পেছনে রেখে রেগে ও বেগে তিনি হেঁটে চার্চের বড় গেটটির ভেতর ঢুকে গেলেন। পরনে তাঁর অন্য নানদের মতো একই পোশাক। খুব সাধারণ কিন্তু অসাধারণ ভঙ্গিমা। সাদা শাড়ি, নীল পাড়। সুতির সাদা ব্লাউজ, হাত পুরোটা ঢাকা। রেখায় পরিপূর্ণ দুটি হাত। পায়ে মধ্যযুগীয় চামড়ার স্যান্ডেল। বোঝা গেল কোনো ব্র্যান্ডের নয়, অর্ডার দিয়ে তৈরি করা কলকাতায়। একজন তরুণীর মতো হেঁটে চার্চের ভেতরে টিনশেডের একটি প্রশস্ত ঘরে ঢুকে গেলেন।

ঘরটাকে স্কুলঘরের ক্লাসরুম মনে হলো, লম্বা বেঞ্চ ও কাঠের টেবিল। মন খারাপ করা মুখে বসলেন তিনি। ঠিক তাঁর উল্টো দিকে বসতে বললেন আমাকে। অন্যরা জানালার বাইরে থেকে দৃশ্যটি দেখছিলেন। বসতেই তিনি বললেন, ‘তুমি যে আমাকে বাধা দিলে, তার জন্য কি তুমি ক্ষমাপ্রার্থী নও? আমাকে পুরান ঢাকায় যেতে হবে। ওখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে অনেক শিশু। এই মুহূর্তে তারা আমার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে...।’

কথা শেষ না হতেই লজ্জিত আমি দুই হাত তুলে ক্ষমা চাইলাম। স্বস্তি পেলেন মাদার। লেখার সঙ্গে এই সাদা-কালো আলোকচিত্রটি সেই মুহূর্তে ধারণ করা হয়। তাঁকে আমার কোনো কিছু বলতে হয়নি। এমনিতেই তিনি রেগে ছিলেন। আমার ক্যামেরা যখন এই মুখ ফোকাস করে, তিনি যেন অলৌকিক কোনো প্রান্তরে চলে গেলেন। এমনিতেই কাপড়ে আবৃত মাথার কোণে হাত ঠেকাতেই ক্লিক করে আমার ক্যামেরা। ঘরটিতে পর্যাপ্ত আলো ছিল না। কিন্তু ছবি তোলার মুহূর্তে কি জানি কোথা থেকে এক টুকরো আলো এসে ঠিকরে পড়ল মায়াবী ওই মুখে।

গাড়িতে ওঠার আগে আবারও ক্ষমা চাইলাম। বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন। দূর থেকে দেখলাম তাঁর মুখে হাসি। যদি মাদার তেরেসার এই দৃশ্য ধরতে পারতাম।

লেখক: আলোকচিত্রশিল্পী