চে-র জন্য কান্না নয়

চে গুয়েভারা (১৯২৮–১৯৬৭)
চে গুয়েভারা (১৯২৮–১৯৬৭)

চে গুয়েভারাকে হত্যা করা হয় আজ থেকে ৫০ বছর আগে, বলিভিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তাঁর মতো কিংবদন্তির মৃত্যু নিয়ে যেন কোনো সংশয় না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হত্যাকারীরা উন্মুক্ত স্থানে তাঁর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ রেখে দিয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, চে-র মৃত্যুর মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটবে তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা মানুষের সব রকম আবেগ আর ভালোবাসার। তাদের হিসাবে ভুল ছিল।

বলিভিয়ার দূরবর্তী এক গ্রামে ৫০ বছর আগের অক্টোবরের ৯ তারিখের সেই নৃশংসতার স্মৃতি অত্যাচারীকে ঘৃণা করতে শেখায় আমাদের। মানুষের মুক্তির জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে গেছেন শতাব্দীর মহানায়ক চে।

বেঁচে থাকলে চে-র বয়স হতো ৮৮ বছর। হয়তো স্বাভাবিক মৃত্যু হতো তাঁর, যেমনটা হয়েছে তাঁর সহযোদ্ধা ফিদেলের। চে গুয়েভারা আর ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন একই সংগ্রামের যুগল মহানায়ক। দুজনই অনাগত প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন সাহসিকতার বার্তা।

সিআইএর প্রত্যক্ষ নির্দেশে বলিভিয়ার সামরিক বাহিনীর এক সৈনিকের গুলিতে চে-র নিহত হওয়ার ঘটনা সবারই জানা। হত্যার ঘটনায় মূলত জড়িত ছিলেন মায়ামিতে আশ্রয় নেওয়া কিউবার প্রতিবিপ্লবী ফেলিক্স রদ্রিগেজ। বিপ্লবপূর্ব কিউবায় একনায়ক বাতিস্তার পুলিশ বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন রদ্রিগেজ।

সিআইএ চে-র বলিভিয়া অভিযানের তথ্য পাওয়ার পর সে দেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। যে অঞ্চলটিতে চে-র গেরিলা বাহিনী যুদ্ধ করছিল, সেখানে মাসখানেক আগে থেকে মার্কিন সহায়তায় সামরিক অভিযান শুরু করেছিল বলিভিয়ার সেনা কমান্ড। সেই অভিযানেই একপর্যায়ে আহত চে ধরা পড়েন। চে-র আটক হওয়ার সংবাদ পাওয়ার পর তাঁকে জেরা করার জন্য মার্কিন প্রশাসন সেখানে রদ্রিগেজকে পাঠায়। কিন্তু আহত ও বন্দী চে কোনো রকম প্রশ্নের উত্তর দেননি। তবে চে-কে হেয় করার উদ্দেশ্যে রদ্রিগেজ নানা রকম বানোয়াট তথ্য প্রচার করতে থাকেন।

আটকের পর চে বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর জীবন শেষ হয়ে আসছে। তাই আহত অবস্থায় দাঁড়িয়ে সেই সৈনিককে বলেছিলেন, ‘কাপুরুষ, মারো, গুলি করো। তোমাদের গুলিতে মরবে কেবল মানুষটি।’ সেটাই ছিল চে-র জীবনের শেষ বক্তব্য।

বলিভিয়ার ভ্যালেগ্রান্দে নামের সেই প্রত্যন্ত জায়গার অজানা এক স্থানে তারা পুঁতে রেখে যায় চে-র মৃতদেহ। কিন্তু মৃত্যুর দিন থেকেই যেন হত্যাকারীদের পিছু নিয়েছেন চে। কারণ, হত্যাকারীরা সকল দেশের, সকল সমাজেই হয়ে পড়েছে ঘৃণিত।

মৃত্যুর অর্ধশত বছর পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রস্তুতি নিচ্ছে চে-কে নতুনভাবে স্মরণ করার। কেবল কিউবা আর সমমনা রাষ্ট্রগুলোই নয়, আইরিশ প্রজাতন্ত্র চে-র প্রতিকৃতি আঁকা স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে, জাপানে মুক্তি পেয়েছে বলিভিয়ার অভিযানে চে-র নিহত সহযোদ্ধা, জাপানি বংশোদ্ভূত বলিভীয় তরুণ ফ্রেডি মায়েমুরাকে নিয়ে তৈরি একটি ছায়াছবি। আর চে যেখানে নিহত হয়েছেন, সেই বলিভিয়ায় চলছে সপ্তাহব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন।

বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘চে-র জন্য কান্নার সময় এখন নয়, বরং এখন সময় হচ্ছে শক্তি সঞ্চয় করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামকে আরও বলীয়ান করে তোলার। চে হলেন সেই সংগ্রামেরই একটি অংশ, সামরিক একনায়ককে মোকাবিলা করতে যিনি অস্ত্রধারীদের কাছ থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে আনায় ব্রতী হয়েছিলেন।’

বলিভিয়ায় চে-র অরণ্য যোদ্ধাদের অভিযান আগাগোড়াই ব্যর্থ ছিল বলে যাঁরা দাবি করে থাকেন, তাঁদের সেই দাবি এখন ক্রমেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কারণ চে-র সেই গেরিলা দল বলিভিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে শত্রুকে ঠিকই পর্যুদস্ত করতে পেরেছিল। কামিরি শহরে এরা প্রথম বিজয় অর্জন করলে যুক্তরাষ্ট্র শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাই দেরি না করে যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয়।

চে-র মৃত্যু ছিল কিউবার বিপ্লবের পর থেকে বিপ্লবীদের হত্যা করার যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের অব্যাহত চেষ্টার একটি অংশ। হত্যার মধ্য দিয়ে এদের প্রভাব মুছে ফেলার যে চিন্তা মার্কিন প্রশাসনের ছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি। বরং মৃত চে জীবিত গুয়েভারার চেয়ে আরও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে বিশ্বের বিপ্লবীদের এখনো উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন। শতাব্দীর মহানায়ক তাই আজও আমাদের শোনাচ্ছেন আশার বাণী, বলছেন হতাশার কালো মেঘ ঠিকই একদিন কেটে যাবে।

জাপানে মুক্তি পেল চে-র সহযোদ্ধাকে নির্মিত চলচ্চিত্র

আজ ৯ অক্টোবর ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্ব স্মরণ করবে আর্জেন্টিনায় জন্মগ্রহণকারী কিউবার বিপ্লবে ফিদেলের সহনায়ক আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে। চে-র মৃত্যুর অর্ধশত বার্ষিকীতে দেখানো হবে জাপানি পরিচালক জুনজি সাকামোতোর পরিচালনায় নির্মিত চলচ্চিত্র আর্নেস্তো। চে-র মৃত্যুবার্ষিকীর প্রাক্কালে ৬ অক্টোবর জাপানে মুক্তি পেয়েছে ছবিটি।

ছবির নামের সঙ্গে চে-র নামের মিল থাকলেও এর মুখ্য চরিত্র চে নন। বলিভিয়ার জাপানি বংশোদ্ভূত তরুণ ফ্রেডি মায়েমুরা এর মূল চরিত্র। বিপ্লব ও মানবমুক্তির স্বপ্ন আন্তরিকভাবে মনে ধারণ করার জন্য চে-সহ অন্যদের কাছে এই বলিভীয়-জাপানি তরুণ পরিচিত ছিলেন আর্নেস্তো হিসেবে।

ফ্রেডি মায়েমুরার কথা পরিচালক সাকামোতো জানতে পেরেছিলেন তাঁর মৃত্যুর অনেক পর। ফ্রেডির জীবনকে ঘিরে একটি কাহিনিচিত্র তৈরির ভাবনা ছিল মায়েমুরার।

ফ্রেডি মায়েমুরা ষাটের দশকের শুরুতে কিউবায় গিয়েছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার জন্য। সেখানে কিউবার বিপ্লবীদের সাহচর্য পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে চে বলিভিয়ায় গেরিলা অভিযান শুরু করলে তাঁর সহযোদ্ধা হিসেবে ফ্রেডি যোগ দিয়েছিলেন সেই দলে। সেখানেই যুদ্ধরত অবস্থায় মাত্র ২৬ বছর বয়সে প্রাণ হারান তিনি।

জাপান ও কিউবার যৌথ উদ্যোগে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে উভয় দেশের শিল্পীরা অভিনয় করেছেন। একই সঙ্গে ছবিটি হাভানায়ও মুক্তি পাচ্ছে।

আছে, আছে...

(চে গুয়েভারার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি)

মঈনুল শাওন

এখনো কি কেউ আছে?

শুধান কমরেড চে

নিজের ছায়ায় লুকোতে লুকোতে

কতকাল মানুষ বাঁচে।

এখনো কি কেউ আছে?

সুনসান নীরবতা

সাগরে-পাহাড়ে

গ্রাম-শহরে

মুমূর্ষু মানবতা

রোদের গায়ে ঘা দিয়ে দিয়ে

কারা তাথৈ নাচে?

নাই তাহলে কেউ আজ?

হঠাৎ চমকানো বিদ্যুতের মতো

শূন্যে আন্দোলিত মুষ্টিবদ্ধ বহু হাত চায়

ভাত-কাপড়-জমি-কাজ...

ওদিকে কাত হয়ে

পড়ে গণতন্ত্রের সাজ

শূদ্রের উঠোনে সদা সৌধ গড়েন

নয়া লিবারেল মহারাজ।

তবু এখনো কি কেউ আছে?

হাঁকেন আর্নেস্তো গুয়েভারা চে...

স্লোগানে স্লোগানে মাতে আকাশ

বঙ্গভূমির কাছে

পুঁজির শিকল বিকল না করে

গরিব কি কখনো বাঁচে?