লড়াকু সান্ত্বনার গল্প

সান্ত্বনা রানী রায় অনুশীলন করছেন l ছবি: প্রথম আলো
সান্ত্বনা রানী রায় অনুশীলন করছেন l ছবি: প্রথম আলো

সবকিছুতেই যেন পারদর্শী তিনি। মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, দৌড়, ম্যারাথন দৌড়, সাঁতার, কারাতে দো ও তায়কোয়ান্দো। চলতি বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়ার পিয়ংইয়ংয়ে ২০তম তায়কোয়ান্দো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে চেক প্রজাতন্ত্রের প্রতিযোগীকে হারিয়ে সান্ত্বনা রানী রায় বাংলাদেশের পক্ষে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেন। ৭৫ কেজি ওজন বিভাগের এ খেলায় উত্তর কোরিয়া সোনা এবং রাশিয়া রুপা জেতে।

সান্ত্বনা রানী রায়ের সাফল্য এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৪ সালের এপ্রিলে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত সপ্তম এশীয় তায়কোয়ান্দো চ্যাম্পিয়নশিপে স্বাগতিক নেপালকে পরাজিত করে তিনি জেতেন সোনার পদক। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় জাতীয় আইটিএফ তায়কোয়ান্দো চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় এবং পরের বছর জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আন্তর্জাতিক তায়কোয়ান্দো চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় আইটিএফ তায়কোয়ান্দো চ্যাম্পিয়নশিপে হয়েছিলেন সেরা খেলোয়াড়।

সান্ত্বনা রানী রায়
সান্ত্বনা রানী রায়

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সারপুকুরের হরিদাস গ্রামের কৃষক পরিবারের মেয়ে সান্ত্বনা। বাবা সুবাস চন্দ্র রায় কৃষক, মা যমুনা রানী রায় গৃহিণী। কুড়িগ্রামের একটি বেসরকারি সংস্থায় মাঠ সংগঠকের চাকরি করেন সান্ত্বনা।

যেভাবে শুরু
২০০৫ সালে সান্ত্বনা রানী রায় তখন রংপুর সরকারি কলেজে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে পড়েন। তখন রংপুর বিয়াম কলেজের শিক্ষক এ বি বাবেল তাঁকে কারাতে দো শেখার সুযোগ দেন। এরপর ২০১০ সালের মাঝামাঝি রাজশাহী সরকারি কলেজে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য ভর্তি হন সান্ত্বনা রানী রায়। সেখানে শিক্ষক এস এম তাহমিদুল হকের তত্ত্বাবধানে তায়কোয়ান্দোর প্রশিক্ষণ নেন। ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকায় পরীক্ষা দিয়ে সান্ত্বনা রানী রায় নিজে ‘ব্ল্যাক বেল্ট’ অর্জন করেন।

ঘটনাবহুল পিয়ংইয়ং যাত্রা
উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে ২০তম তায়কোয়ান্দো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান সান্ত্বনা। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তায়কোয়ান্দো অ্যাসোসিয়েশন তাঁর থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু বিমান ভাড়া, অংশগ্রহণ ফি, পোশাক পরিচ্ছদের খরচসহ সান্ত্বনা রানী রায়কে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা জমা দেওয়ার কথা জানানো হয়। কিন্তু তাঁর পরিবারের সেই সামর্থ্য নেই। বিষয়টি জেনে লালমনিরহাটে বিভিন্ন ক্রীড়ামোদী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাঁকে সহায়তা করেন। এরপর ৭ েসপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রতিবেদন ছাপা হয় ‘বিশ্বকাপে যেতে পারবেন সান্ত্বনারা?’ এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে একে একে প্রকাশিত হয় সান্ত্বনাকে নিয়ে খবর। সান্ত্বনা বলেন,দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ সহযোগিতা করেন। পুরো টাকা জোগাড় হয়ে যায়। সান্ত্বনা প্রথম আলোর কাছে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তায়কোয়ান্দো অ্যাসোসিয়েশনের টুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহাজাহান আলী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর্থিক সংকটের বিষয়টি নিয়ে সান্ত্বনার মতো আমরাও কম চিন্তায় ছিলাম না। প্রথম আলোতে একটার পর একটা প্রতিবেদন হচ্ছে আর সান্ত্বনার সহায়তার পরিমাণও বাড়ছে। এ যেন জাদুর মতো।’

নিজ গ্রামে তারকা
হরিদাস গ্রামে সান্ত্বনা এখন রীতিমতো এক তারকা। সান্ত্বনাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের অনেকেই তাঁর সাফল্যের গল্প শুনতে এসেছেন। তাঁরা সান্ত্বনার সঙ্গে ছবি ও সেলফিও তুলছেন। সান্ত্বনার দাদি কুসুম বালা বলেন, ‘এখন সবাই আমাদের বাড়িতে নাতনিকে দেখতে আসে। আগে ওর বিয়ে কেন হচ্ছে না, ও কেন মারামারির খেলা খেলে ইত্যাদি কত কথাই না শুনতে হতো।’

সান্ত্বনার মা যমুনা রানী বলেন, ‘আমার ছেলেমেয়েরা সবাই লেখাপড়া করে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। ওরা খেলাধুলা করে, এসব অনেকের পছন্দ নয়। তবু তারা থেমে থাকেনি।’

সান্ত্বনার ইচ্ছা লালমনিরহাটে একটি তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করার। সেই স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছেন তিনি।