রোহিঙ্গা নারীর জীবন

শরণার্থী শিবিরের পরিস্থিতি এখনো নারীদের জন্য যথেষ্ট অনুকূল নয় l ছবি: প্রথম আলো
শরণার্থী শিবিরের পরিস্থিতি এখনো নারীদের জন্য যথেষ্ট অনুকূল নয় l ছবি: প্রথম আলো

 ‘আমার নাম মোস্তফা হাতুন। আমার স্বামীর নামও একই। মোস্তফা আমদ। বুথিডংয়ের রোয়ামায় আমাদের বাড়ি। ওখানেই জন্ম। লেখাপড়া শিখিনি। সাত-আট বছর বয়সে মাদ্রাসায় পাঠিয়েছিল। দুই বছর মতো গেছি। পরে আর যাইনি। ওখানে মুসলমান মেয়েরা স্কুলে যায় না। ছেলেরাই ১০ ক্লাসের পর পড়তে পারে না। আমাদের দেশে ১৮–এর আগে বিয়ে নিষেধ। আমার স্বামী হালচাষ করত। চার ছেলে চার মেয়ে রেখে মারা গেছে। ছেলেরা ১০ ক্লাস পড়েছে। এরপর পড়ার সুযোগ নেই, চাকরিও নেই। কিন্তু ছোট মেয়ে ইসমত আরাকে স্কুলে পাঠাই। ক্লাস সিক্সে পড়ে। মেয়ের পড়ার শখ আছে। নাচ/গান শেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। সব সময় রাখাইনের ছেলেরা উৎপাত করে েময়ে ইসমতকে। লুন্টিন (পুলিশ) তো আছেই। ওরা বোরখার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে চেক করে। এতে অস্বস্তি হয়। সহ্য করতে হয়। নইলে নির্যাতন হবে দ্বিগুণ। কোনো কিছুর কোনো বিচার নেই। কিছু বললে কেটে ফেলবে। এখন তো বাংলাদেশে চলে এসেছি বড় মেয়ের কাছে। ওরা এখানে আগেই এসেছে। সে আরেক গল্প। আমরা হাসপাতালে যেতে পারি না। বর্ডারে ঘুষ দিয়ে বাংলাদেশে এসে চিকিৎসা করাতে হয়। সেটা করারও সুযোগ পাইনি। কত মেয়ে যে প্রতিবছর বাচ্চা হতে গিয়ে মারা যায়। এখন বাংলাদেশে এসেছি। আমার এই মেয়ের আর বাচ্চা-কাচ্চা হবে না। কী যেন করেছে। ওখানে আমাদের পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। মানুষ খুন করে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়েছে। সাত দিন পাহাড় থেকে পাহাড়ে ঘুরে তারপর পালংখালী দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছি। কফির দানা আর সিম বিচি খেয়ে থেকেছি। পায়ের ভেতর গাছের ডাল ঢুকে গিয়েছিল। নখ উঠে গেছে। তবু ভালো আছি। দেশ ছাড়ার পথে কত রোহিঙ্গার লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। থাকতে দিলে আমি বাংলাদেশেই থেকে যাব। এখানে মরে গেলে অন্তত একটা কবর তো পাব। শিয়াল কুকুর লাশ খাবে না। কেউ পুড়িয়েও দেবে না। আর আমার ইসমত পড়তে চায়। এখানে যদি পড়ার একটু সুযোগ পাওয়া যায়।’

মায়ের কোলে নিশ্চিতে সন্তান, কিন্তু মায়ের মনে ভয়
মায়ের কোলে নিশ্চিতে সন্তান, কিন্তু মায়ের মনে ভয়

শরণার্থী শিবিরের নারী জীবন

চলতি বছরের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাথেডং, বুথিডং ও মংডু থেকে যত শরণার্থী এসেছে, তাদের বড় অংশই নারী ও শিশু। সায়েরা বেগম তাঁদের একজন। উন ছি প্রাং শরণার্থী শিবিরে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। গত ২৭ সেপ্টেম্বর শরণার্থী শিবিরের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। বুথিডংয়ের ফিরহালি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তিন সন্তানের জননী। সবচেয়ে ছোটটির বয়স তিন, বড়টির সাত। গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার পর স্বামীকেও খুন করে মিয়ানমারের সেনারা। মৃত স্বামীর দাফন না করেই জান নিয়ে পালান। পেছনে কাঠের দোতলা বাড়ি, গরু-ছাগল, ঘরে ২০ মণ চাল। কিন্তু হাতে কোনো টাকা নেই। নৌকার মাঝির ভাড়া মিটিয়েছেন নাকফুল দিয়ে।

সায়েরা যখন কথা বলছিলেন, তাঁর সঙ্গে তখন আরও অনেকে দাঁড়িয়ে। তাঁরা বলছিলেন, কীভাবে মেয়েরা সেনাসদস্য আর উগ্রবাদী রাখাইনদের ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, যাদের অল্পস্বল্প গয়নাগাটি আছে, তারা এখন টেকনাফ, উখিয়ায় স্বর্ণকারদের দোকানে ভিড় জমাচ্ছে। ২৮ সেপ্টেম্বর টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের কাছে বেশ কটি স্বর্ণের দোকানে রোহিঙ্গা নারীদের ভিড় দেখা যায়। স্বর্ণকার তোঁয়ায় মং চিং প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা নারীদের অনেকেই আসছেন, তাঁর ভাষায় ‘গুঁড়োগাঁড়া’ গয়না নিয়ে। তাঁরা গয়নার ওজন করান। তারপর একদিন একটা নাকফুল, আবার কিছুদিন পর কানের দুল, আরও কিছুদিন পর আংটি—এভাবে বিক্রি করেন। জীবন বাঁচাতে তাঁদের টাকার দরকার, সে কারণেই শখের গয়না বিক্রি করছেন।

নারীরা জীবন বাঁচিয়ে এপারে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু শরণার্থী শিবিরের পরিস্থিতি এখনো নারীদের জন্য যথেষ্ট অনুকূল নয়। ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী ৭ দিনে টেকনাফের লেদা, নয়াপাড়া, বালুখালী, উখিয়ার কুতুপালং, উন ছি প্রাংয়ের শরণার্থী শিবিরের নারীরা তাঁদের নানা সমস্যার কথা জানিয়েছেন। সমস্যার শুরু পোশাক দিয়ে। সারা দেশ থেকে মানুষ পোশাক পাঠাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এই পোশাকে নারীরা অভ্যস্ত নন। তাঁরা পরেন ব্লাউজ আর লুঙ্গি। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সময় যে কাপড় নিয়ে এসেছিলেন, ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে তা-ই পরছেন। শরণার্থী শিবিরে তাঁদের গোসল আর টয়লেটের আলাদা ব্যবস্থা নেই। মাসিকের সময় সমস্যা আরও প্রকট। রাতের বেলা শিবিরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শরণার্থী শিবিরের ভেতরে নারীদের নিরাপত্তাটা বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিবিরের ভেতরে বেশ কিছু নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন, সহিংসতারও শিকার হয়েছেন। আশঙ্কা আছে পাচারেরও।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ন্যাশনাল কমিউনিকেশন অফিসার শিরিন আখতার জানান, এ পর্যন্ত মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা ৬ হাজার ২৬৫ জন নারীকে চিহ্নিত করে বিশেষ সেবার আওতায় নেওয়া হয়েছে, ১৯৯৯ জনকে মানসিক সেবা দেওয়া হয়েছে, সহিংসতার শিকার ২০৫ জন নারীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। মাসিক ব্যবস্থাপনা সেবা পেয়েছেন ২ হাজার ১৩৫ জন।

অন্যদিকে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের জোসেফ সূর্যমণি ত্রিপুরা বলেছেন, তাঁরা বিভিন্ন শিবিরে তাঁদের কর্মী নিয়োগ করেছেন নজরদারির জন্য। সব হারানো শরণার্থীদের কেউ ফুসলানোর চেষ্টা করলে তাদের ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসনকে জানানো হচ্ছে।