মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় ৬০ বছর

পাবনা মানসিক হাসপাতালের খেলার মাঠ। ছবি: হাসান মাহমুদ
পাবনা মানসিক হাসপাতালের খেলার মাঠ। ছবি: হাসান মাহমুদ


বেলা তখন ১১টা। মূল ফটক পেরিয়ে, খেলার মাঠ পেরিয়ে আমরা তখন হাসপাতালের মূল ভবনে। এতটুকু পথ পেরোতেই চোখে পড়ল ভাঙাচোরা বেশ কিছু ভবন। এ ভবনগুলো যেন সাক্ষী হয়ে আছে ৬০ বছরের পথচলার। ১১ অক্টোবর আমরা তখন দেশে মানসিক চিকিৎসার সবচেয়ে বড় সরকারি প্রতিষ্ঠান পাবনা মানসিক হাসপাতালে।
হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, গোসল করছেন অনেকে। তাঁদের গোসল দেখে মনে হলো, এখানে সবাই সবার আপনজন, একজন অন্যজনের মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছেন, গোসল শেষে গা মুছিয়ে দিচ্ছেন, সহযোগিতা করছেন আরও নানা কাজে। ঘড়ি ধরে এক ঘণ্টার মধ্যে গোসলযজ্ঞ শেষ হলো। তারপর সারি ধরে চলে গেলেন নিজ নিজ কক্ষে। এই ফাঁকে কথা হলো হাসপাতালের সেবা তত্ত্বাবধায়ক (মেট্রন) শামীম আকতারের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘রোগীদের মধ্যে একটা পারিবারিক বন্ধন রয়েছে। পরিবারের মতোই তাঁরা হাসপাতালেও একে অপরের খোঁজ রাখেন। ভালো-মন্দ দেখভাল করেন।’

হাসপাতালের প্রধান ফটক
হাসপাতালের প্রধান ফটক


এরপর খাবারের অপেক্ষা। ঠিক দুপুর ১২টায় খাবার পৌঁছাল ঘরে ঘরে। শান্ত-সুবোধ শিশুর মতো খাবার নিলেন সবাই। এবার ঘুম।
ততক্ষণে আমরা ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো হাসপাতাল। শুনেছি, হাসপাতালের আদ্যোপান্ত। দুপুর গড়িয়ে হয়েছে বিকেল। হাসপাতালের রসুইঘরে দেখা গেল রাতের খাবারের প্রস্তুতি চলছে। বিশাল ছয়টি পাত্রে রাতের খাবার রান্নায় ব্যস্ত বাবুর্চিরা। খাদ্য সরবরাহ কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বললেন, ‘মোট চার বেলা খাবার দেওয়া হয় রোগীদের। সকাল আটটায় রুটি, সুজি ও ডিম। দুপুর ১২টায় থাকে মাছ/মাংস, ডাল, সবজি ও ভাত। রাতের খাবারটা সন্ধ্যার আগেই হয়। ঠিক দুপুরের মতো। রাত নয়টার দিকে আবার কলা ও বিস্কুট খেয়ে সবাই ঘুমাতে যান।’

হাসপাতালের ওয়ার্ডে বিশ্রাম–পর্ব। ছবি: ছুটির দিনে
হাসপাতালের ওয়ার্ডে বিশ্রাম–পর্ব। ছবি: ছুটির দিনে


গাংগুলীর স্বপ্ন

১৯৫৭ সাল। পাবনার তৎকালীন সিভিল সার্জন মোহাম্মদ হোসেন গাংগুলী স্বপ্ন দেখেছিলেন এই হাসপাতালের। তিনি ছিলেন বরিশালের মানুষ। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আজও তাঁর নামটি লেখা আছে হাসপাতালের বোর্ডে। ১৯৫৭ সালের শুরুর দিকে প্রথমে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল শহরের শীতলাই জমিদারবাড়িতে। প্রথম বছরেই পাবনা মানসিক হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছিল ৮০ জন। এর মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন ৪০ জন। এরপর ধীরে ধীরেই হাসপাতালের এগিয়ে চলা। হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ কর্মকর্তা ব্রজ গোপাল সাহা শোনালেন সেই গল্প।
আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই হাসপাতালের মূল অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু হয়। পাবনা সদর উপজেলার হিমাইতপুর

মোহাম্মদ হোসেন গাংগুলীর হাত ধরেই  গোড়াপত্তন হয় হাসপাতালের
মোহাম্মদ হোসেন গাংগুলীর হাত ধরেই গোড়াপত্তন হয় হাসপাতালের


ইউনিয়নের হিমাইতপুর গ্রামে অধিগ্রহণ করা হয় ১১১ দশমিক ২৫ একর জমি। বিশাল এলাকাজুড়ে শুরু হয় নির্মাণকাজ। নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৫৯ সালে। হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানালেন, অধিগ্রহণ করা জমির সিংহভাগই ছিল পাবনার আধ্যাত্মিক সাধক শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের। জমি অধিগ্রহণের সময় তিনি ভারতে ছিলেন। ফলে অধিগ্রহণের অর্থ তাঁর ব্যাংক হিসাবে জমা দেওয়া হয়েছিল। ঠাকুরের অনুসারীদের দাবি, আজও সেই টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করা হয়নি।
হাসপাতালের রোগী সেবার তথ্য থেকে জানা গেল, ১৯৫৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আবাসিকে রোগী ভর্তি হয়েছেন ৭৯ হাজার ৪৪৪ জন। তাঁদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৬৬ হাজার ৭৯০ জন। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেওয়ার সংখ্যা আরও বেশি। ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ২ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫৬ জন। এর মধ্যে নারী ছিলেন ১ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৯ জন, পুরুষ ১ লাখ ২৪ হাজার ১৬৭ জন।

ব্রজ গোপাল সাহা
ব্রজ গোপাল সাহা


অন্দরের কথা

৬০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল পাবনা মানসিক হাসপাতালের। ১৯৬৬ সালে প্রথম দফায় শয্যাসংখ্যা বাড়িয়ে ১৫০ ও পরে ২০০টি করা হয়। ১৯৯৬ সালে শেষ দফায় ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হয় হাসপাতালটিকে। এর মধ্যে ১২০টি পেয়িং ও ৩৮০টি সাধারণ শয্যা রয়েছে। চিকিৎসা হয় অন্তর্বিভাগে, বহির্বিভাগ ও বিনোদনমূলক—এই তিন বিভাগে। অন্তর্বিভাগে ৪০০ পুরুষ ও ১০০ নারী চিকিৎসা নিতে পারেন। বহির্বিভাগে প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৪০ জন রোগী চিকিৎসা পরামর্শ নেন।
অবকাঠামো বলতে সবই আছে। দ্বিতল হাসপাতাল ভবন, বহির্বিভাগ, প্রশাসনিক ভবন, বিনোদন বিভাগ, রান্নাঘর, ধোপাঘর, সিনেমা হল, হস্তশিল্প ভবন, তাঁতশিল্প ভবন, ওষুধ ও মালামাল সংরক্ষণ ভান্ডার, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক ভবন ও কটেজ মিলিয়ে মোট ৫৩টি ভবন রয়েছে। তবে অধিকাংশই এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। বর্তমানে ব্যবহৃত ভবনগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।
অবকাঠামো জরাজীর্ণ; পাশাপাশি চিকিৎসক, সেবিকা ও কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকটে ভুগছে হাসপাতাল। লোকবল সংকটের কারণে হাসপাতাল পরিচালনায় কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অধিকাংশ যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। কিছু যন্ত্রপাতি থাকলেও তা চালানোর লোক নেই।

রোগীদের জন্য খাবার রান্না হচ্ছে
রোগীদের জন্য খাবার রান্না হচ্ছে


তবে আনন্দের সংবাদ হলো বহির্বিভাগের রোগীদের হাসপাতাল থেকেই এখন এক থেকে দুই মাসের ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। এই বিশাল পরিমাণ ওষুধ বহনের জন্য রোগীর স্বজনদের সরবরাহ করা হচ্ছে হাসপাতালের তৈরি ব্যাগ, যা তৈরি করছেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নারীরা।
এসব কথা শুনতে শুনতে চোখ আর্দ্র হয়ে এল অন্য এক কথা শুনে। হাসপাতালে এমন ২১ জন রোগী রয়েছেন, যাঁরা সুস্থ হয়েছেন ২০ থেকে ২৫ বছর আগে। কিন্তু তাঁদের স্বজনেরা ফিরিয়ে নেননি। যাঁরা রোগীদের ভর্তি করেছিলেন, তাঁদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক তন্ময় প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, ‘হয়তো বড় কোনো স্বার্থে ভুল ঠিকানা ব্যবহার করে এসব রোগীকে ভর্তি করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকায় তাঁরা এখন নিজেরাও অন্যত্র যেতে চাইছেন না। তবে তাঁরা হাসপাতালে ভালোই আছেন। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তাঁদের আপন করে নিয়েছেন।’
সমস্যাসংকুল এই হাসপাতাল তবু মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় অনন্য। এখনো বিশাল করিডরের এই হাসপাতালের সবুজ চত্বরে ঢুকলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

ব্রজ গোপাল সাহা
ব্রজ গোপাল সাহা


মায়ার বাঁধনে ব্রজ গোপাল

পুরো নাম ব্রজ গোপাল সাহা। তবে হাসপাতালের সবার কাছে কালা দা নামে পরিচিত। বয়সের ভারে অনেকটাই নুয়ে পড়েছেন। পাবনা মানসিক হাসপাতালে অকুপেশন থেরাপিস্ট পদে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৬৬ সালে। দায়িত্ব ছিল রোগীদের বিনোদন ও খেলাধুলার মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া। ২০০০ সালে চাকরি থেকে অবসর পেয়েছেন। কিন্তু এখনো ছাড়তে পারেননি হাসপাতালের মায়া। ব্যক্তিগত জীবনে সংসারও পাতেননি মানুষটি। সারা দিন হাসপাতালেই কাটান। ভালো-মন্দ দেখভাল করেন। রোগীদের সঙ্গে গল্প, আড্ডায় মেতে থাকেন। তাঁদের বিভিন্ন বিনোদন দিয়ে সুস্থ রাখার চেষ্টা করেন।
কথায় কথায় বহু গল্প শোনান ব্রজ গোপাল সাহা। তিনি যখন কর্মজীবনে ছিলেন, তখন হাসপাতালের চিত্র ছিল ভিন্ন। নিয়মিত রোগীরা খেলাধুলা করতে পারতেন। বিনোদনের জন্য একটি সিনেমা হল ছিল (বর্তমানে মিলনায়তন)। কিন্তু অর্থাভাবে অনেক কিছুই বন্ধ হয়ে গেছে।
তবে চাকরি না থাকলেও তিনি এই বিনোদনের কিছু ধারা অব্যাহত রেখেছেন। শুধু মায়ার টানে বিনা পারিশ্রমিকে রোগীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন। নিয়মিত খেলাধুলার উদ্যোগ নিচ্ছেন। ফলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নতুন করে একটি টেনিস কোর্ট তৈরির কাজ শুরু করেছেন। ব্রজ গোপাল সাহা বলেন, ‘হাসপাতালের প্রত্যেক রোগী আমার স্বজন। এই চত্বর আমার বাড়ি। তাই হাসপাতাল ছেড়ে যেতে পারি না।’

তন্ময় প্রকাশ বিশ্বাস
তন্ময় প্রকাশ বিশ্বাস


সমৃদ্ধ হাসপাতাল গড়ার চেষ্টা করছি

তন্ময় প্রকাশ বিশ্বাস
পরিচালক, মানসিক হাসপাতাল, পাবনা
মানসিক হাসপাতাল সাধারণ হাসপাতালের মতো নয়। এখানকার চিকিৎসাপদ্ধতি থেকে শুরু করে সবকিছুই আলাদা। ফলে জনবল বেশি প্রয়োজন হয়। কিন্তু জনবল সংকট এখন প্রকট হয়ে উঠেছে। ফলে অনেক কাজই সঠিকভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না। হাসপাতাল ক্যাম্পাস জঙ্গলে ভরে উঠলেও পরিষ্কার করার মানুষ নেই। এ ছাড়া ভবনগুলো পুরোনো হয়ে গেছে। বৃষ্টির দিনে অনেক কক্ষে পানি ঢোকে। এতে রোগীদের সমস্যা হচ্ছে। এর মধ্যেই আমরা হাসপাতালকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করছি। রোগীদের প্রতিটি কক্ষে সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা রয়েছে। এর মাধ্যমে তাঁরা সারাক্ষণ গান শুনতে পারেন। রয়েছে টেলিভিশন, পছন্দমতো অনুষ্ঠান দেখেন সবাই। এ ছাড়া হাসপাতালের চারপাশ নজরদারিতে রাখার জন্য সম্প্রতি ১০৭টি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। লোডশেডিংয়ের সময় হাসপাতাল যাতে অন্ধকারে না থাকে, সে জন্য ৪৮টি সোলার বাতি স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে দুটি করে সোলার লাইট লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। রোগীদের জন্য একটি লাইব্রেরি তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে।
নারী রোগীদের সুন্দর অবকাশ কাটানোর জন্য একটি ছোট্ট পার্ক ও হ্যান্ডবল খেলার জন্য একটি কোর্ট তৈরি করা হচ্ছে। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা পাবনা মানসিক হাসপাতালকে একটি সমৃদ্ধ হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।