অন্য চোখে দেখেন শিমুল

শিল্পী শিমুল সাহা। ছবি: সুমন ইউসুফ
শিল্পী শিমুল সাহা। ছবি: সুমন ইউসুফ

‘ইউ শো অ্যান্ড আই সি’ নামটা দেখে কৌতূহল হয়ই। ঘরটাতে ঢোকার মুখে এই লেখা দেখে ভেতরে ঢুকলে কিছুটা ধাক্কাও খেতে হবে। মনে হবে হাজার হাজার রেডিয়াম বাতি আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। একটু আগেও যেখানে ছিল কালো রঙের স্কেচ। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মোটিফ থেকে করা। সুপ্রিম কোর্ট থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে শুরুতে ছবি তুলেছিলেন। এরপর কম্পিউটারের সফটওয়্যার দিয়ে ১৬ X ৮ ফুট কাগজে প্রিন্ট নেন। সেই প্রিন্টকে ১ X ১ ফুট আকারের কয়েক শ টুকরায় ভাগ করেন। পরে মেলানোর জন্য প্রতি টুকরায় ক্রমিক নম্বর দেন। কালো রঙের স্কেচের প্রতিটি রেখায় ফসফোরসেন্ট পিগমেন্ট দেন। ঘরটিতে এগুলো এমনভাবে বসানো যে ঘরে যদি কেউ প্রবেশ করে, তখন সেন্সরের কারণে ঘরের বাতি বন্ধ হয়ে সবুজ বাতি জ্বলে উঠবে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে গত বছর শিল্পী শিমুল সাহার এ কাজটি প্রদর্শিত হয়। সম্প্রতি বৃত্ত আর্টস ট্রাস্টের হয়ে দলগত একটি প্রদর্শনী হয়ে গেল আমস্টারডামে। সেখানেও ছিল শিমুলের কাজ। কাজের ধরনে, ভাবনায় নতুনত্ব আনার চেষ্টা থাকে সব সময়। যেকোনো বিষয়ের গভীরে যেতে চান। গবেষণা করেন। গত বছর নেপালে একটি আর্টিস্ট রেসিডেন্সিতে যাওয়ার সুযোগ হয় শিমুল সাহার।

নেপালের রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া পাসপোর্ট অাকারের ছবি (বাঁয়ে) থেকে শিমুলের তৈরি বিশালাকার শিল্পকর্ম
নেপালের রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া পাসপোর্ট অাকারের ছবি (বাঁয়ে) থেকে শিমুলের তৈরি বিশালাকার শিল্পকর্ম

রাস্তায় একটি পাসপোর্ট আকারের ছবি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন শিমুল। সেই ছবিটা দিয়ে এক্স-রে মেশিনে বড় শিল্পকর্ম তৈরি করেন। যার দৈর্ঘ্য ছিল ১৯৩ X ১৪২ সেন্টিমিটার। শিমুল বলেন, ‘নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক নিরীক্ষা করে “ইট সিমস টু বি নোন” নামের এ কাজটি করেছি। প্রতিটি কাজ করার আগে অনেক গবেষণা করি। ভেতরের স্বচ্ছতা দেখতে চাই, দেখাতেও চাই। আরেকটি বিষয় হলো আমরা সব সময় কোনো শিল্পকর্মের ওপর আলো ফেলি। কিন্তু আমার কাজের রয়েছে নিজস্ব আলো। আলোকে এমনভাবে সেট করি, যাতে মনে হবে বিষয়টির নিজস্ব আলো আছে।’

সময় তাঁকে বলে দিয়েছে কখন কী করতে হবে। আগে থেকে কোনো কিছু পরিকল্পনা করে করেননি। শুধু নিজের ইচ্ছা পূরণে কোনো ছাড় দেননি। সাধারণ পরিবারের এই ছেলে ভাবেননি কখনো শিল্পী হবেন। নিজের হাতে কিছু না কিছু বানাতে চেষ্টা করতেন। যা-ই সৃষ্টি করেন না কেন, চেষ্টা করেন সেখানে যেন নিজের স্পর্শ থাকে। এখন বুঝতে পারেন ছোটবেলায় ত্রিমাত্রিক ছোট ছোট জিনিস তৈরি করেছিলেন।

সেলফ পোর্ট্রেট শিরোনামের কাজ
সেলফ পোর্ট্রেট শিরোনামের কাজ

টাঙ্গাইল থেকে এসএসসি পাস করার পর ঢাকার নটর ডেম কলেজে ভর্তি হলেন শিমুল। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় এসে গেল। আত্মবিশ্বাস ছিল, নিশ্চয় কোথাও না কোথাও হয়ে যাবে। কিন্তু হলো না। সে সময় তাঁর ছোট পিসির স্বামী বললেন, কিশোরগঞ্জে তিনি যে কলেজে শিক্ষকতা করেন, সেখানে ভর্তি হতে। অগত্যা ছেলেটিকে সেখানে ভর্তি হতে হলো। তখন দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ ছিল। মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসতেন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। মুরাদ নামে তাঁর এক বন্ধুই প্রথম বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে পড়ার কথা। কথাটা মনে ধরে। সপ্তাহে দুই দিন কিশোরগঞ্জে থেকে চারুকলায় আসতেন কোচিং করতে। ছোট পিসি ছাড়া আর কাউকে কিছু বলেননি। বেশি দিন অবশ্য গোপন থাকেনি সে কথা।

টাঙ্গাইলের মধুপুরে তাঁর পরিবারে বসল আলোচনা। সেখানে ছেলেটি বলে ফেললেন অন্য কোথাও আর পরীক্ষা দেবেন না। পড়লে ঢাকার চারুকলাতেই পড়বেন, তা না হলে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে পারিবারিক ব্যবসা দেখবেন। ছেলের এমন জেদের কাছে পরিবার হার মানল। বাবা সুবল চন্দ্র সাহা অবশ্য শিমুলকে বলেছিলেন অন্য কোথাও চারুকলায় পড়ার কথা। মেধাতালিকায় শুরুর দিক থেকে চারুকলা অনুষদে ভর্তি হলেন।

একজন সাধারণ শিমুল সাহা থেকে শিল্পী শিমুল সাহা হওয়ার প্রথম ধাপ এটি। ভর্তি হলেন ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগে। কিন্তু মন পড়ে থাকে ভাস্কর্য বিভাগে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে সৃষ্টিশীল কিছু করা যে হচ্ছিল না। নানা নাটকীয় ঘটনার পর এক বন্ধুর সঙ্গে বিভাগ পরিবর্তন করে ভাস্কর্য বিভাগে আসেন। শিমুল সাহা বলেন, ‘অন্য রকম কিছু সব সময়ই করতে চেয়েছি। সেই সব ভাবনা থেকে ত্রিমাত্রিক কাজের দিকে আগ্রহ বেড়েছে। একবার মা (অঞ্জলি রানি সাহা) খুব অসুস্থ হয়েছিলেন। এক্স-রে করাতে হয়েছিল। সে সময় মায়ের ব্লাউজের একটা হুক এক্স-রে রিপোর্টে দেখে প্রথম মনে হয়েছিল অন্য কোনো কিছুর ছবিও এক্স-রে মেশিন দিয়ে তোলা যেতে পারে। এরপর এক্স-রে মেশিনে চলতে থাকল নানা রকম নিরীক্ষা।’

শিমুল সাহার ‘ইউ শো অ্যান্ড আই সি’
শিমুল সাহার ‘ইউ শো অ্যান্ড আই সি’

রোগ, হাসপাতাল যেন তাঁর পিছু ছাড়ে না। পরিবারের বেশ কয়েকজন কাছের মানুষ ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিমুল সাহা নিজেও কোমায় ছিলেন ১৫ দিন। বিয়োন্ড কমপ্রিহেনশন নামে ক্যানসার আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাথার খুলির ছবি নিয়ে একটা কাজ করেছিলেন। কাজ থেমে থাকে না। চারুকলায় স্নাতক শেষ করে বৃত্ত আর্টস ট্রাস্টে শুরুতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের কাজ দেখতে পান। এর মধ্যে পাকিস্তানের বিকনহাউস ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পান। আবার শিমুলকে নিয়ে পারিবারিক সভা বসল। এবারও সবাই শিমুলের কথা মেনে নিলেন। ‘বৃত্ত ট্রাস্টের শিল্পী মাহবুবুর রহমান ও তৈয়বা বেগম লিপি খুব সমর্থন দিয়েছিলেন।’ বলেন শিমুল। পাকিস্তানের লাহোরে স্নাতকোত্তর করতে করতে ঘোরাঘুরি করেছিলেন। বিভিন্ন সভ্যতার নিদর্শন দেখার সুযোগ হয় তাঁর।

ঘরের বাতি বন্ধ হলে জ্বলে ওঠে ফসফোরসেন্ট পিগমেন্টের সবুজ বাতি
ঘরের বাতি বন্ধ হলে জ্বলে ওঠে ফসফোরসেন্ট পিগমেন্টের সবুজ বাতি

বর্তমানে শিমুল সাহা বৃত্ত আর্টস ট্রাস্টের একজন ট্রাস্টি। দেশ-বিদেশে অনেকগুলো প্রদর্শনী হয়েছে। ভিন্ন ধরনের কাজ দেখে প্রশংসাও পেয়েছেন। শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান শিমুল সাহার কাজ সম্পর্কে বলেন, ‘বিভিন্ন প্রদর্শনীতে শিমুল সাহার কাজ দেখেছি। ভালো লেগেছে আমার। সমসাময়িক ও আধুনিক ভাবনার মিশেল আছে তাঁর কাজে। সারা বিশ্বে এখন এ ধরনের কাজ হচ্ছে। তবে এ ধরনের কাজ আমাদের দেশ বা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে কতখানি উপযুক্ত, সে বিষয়ে অবশ্য আমার মনে প্রশ্ন থেকে যায়।’

শিমুল সাহা পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতাও করেন। এ কাজটি বেশ উপভোগ করেন বলে জানান। এ ছাড়া বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে িরসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কাজ করছেন। দিনের শুরুটা হয় গান দিয়ে। সব ধরনের গান শোনেন। হয়তো নতুন কিছু ভাবনা মাথায় খেলতে থাকে। ইচ্ছা আছে একদিন লাগেজ স্ক্যানিং মেশিন ও এ-ক্সরে মেশিন কিনবেন। সেখান থেকে আরও ভিন্ন কিছু দেখতে পাব আমরা।