আমি পরাজয় মানতে পারি না

>লিওনেল মেসির নামের সঙ্গে ‘জাদু’ শব্দটা ঘুরেফিরে বারবার জায়গা পায়। দেশের ভীষণ প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আবার স্বরূপে দেখা দিলেন তিনি! আর্জেন্টিনা যখন বিশ্বকাপে না খেলতে পারার শঙ্কায় ভুগছিল, তখনই তাঁর হ্যাটট্রিক! কীভাবে তিনি ‘মেসি’ হয়ে উঠলেন? কেমন ছিল এই জাদুকরি ফুটবলারের ছেলেবেলা? ২০১৫ সালে ক্রীড়া সাংবাদিক টম ওয়াটের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার সে গল্পই বলেছেন তিনি।
লিওনেল মেসি
লিওনেল মেসি

সান্তা ফে প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর রোসারিওতে আমার জন্ম। শহরের দক্ষিণে ব্যারিও লাস হেরাস পাড়ায় সুন্দর, ছিমছাম একটা বাড়িতে আমরা থাকতাম। বাড়িটা আগের মতোই আছে। যদিও ছোটবেলায় সেই বাড়ি আমরা ছেড়ে এসেছি, কিন্তু এখনো সুযোগ পেলেই সেখানে যাই। অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়, যারা একটুও বদলায়নি। অবশ্য শুধু বন্ধুই নয়, তারা আমার পরিবারও। পাঁচ বড় ভাই, কাজিন সেখানে থাকে। মনে আছে, ছুটির দিনে আমরা ফুটবল খেলতাম। কখনো নিজেদের মধ্যে, কখনো জোট বেঁধে অন্য কোনো দলের সঙ্গে।

খুব ছোটবেলায় আমি আমার প্রথম ফুটবলটা পেয়েছিলাম। তখন কতই-বা বয়স, তিন বা চার। কে যেন উপহার দিয়েছিল। সেদিন থেকে যেকোনো উপলক্ষে আমি একটা উপহারই চাইতাম—ফুটবল, হোক সেটা বড়দিন বা জন্মদিন। আমি ফুটবল জমাতাম। ঘরের বাইরে নিতাম না, যদি কেউ নষ্ট করে ফেলে, সেই ভয়ে।

বাড়ির চারপাশে সবুজ ছিল, কিন্তু ফুটবল খেলার মতো জায়গা ছিল না। একটু দূরে সেনাবাহিনীর একটা পরিত্যক্ত জায়গা ছিল। দুই বেড়ার মাঝে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় আমরা খেলতাম। তবে আমাদের ফুটবল ম্যাচ জমত মূলত রাস্তায়। সে সময়ের রাস্তা ছিল কাঁচা, শুকনো মাটির। আমাদের ছোট্ট এলাকাটার সবাই সবাইকে চিনত, তাই মায়ের খুব একটা দুশ্চিন্তা ছিল না।

পাঁচ বছর বয়সে খেলা শুরু করেছি। শুরুর দিকে ভাইয়েরা খেলায় নিত না। আমি ছোট, শুধু এ কারণেই নয়, ভাইয়ারা বড়দের সঙ্গে খেলত। আমি খেললে বড়রা আমার পা থেকে বল কেড়ে নিতে পারত না। ভাইয়েরা ভয় পেত, না জানি ওরা রেগে গিয়ে আমার পায়ে লাথি মেরে বসে! এসব কথা অবশ্য আমার মনে নেই, আমি তাদের কাছ থেকেই শুনেছি।

রাস্তায় খেলার সময়টাতেই যোগ দিয়েছিলাম স্থানীয় গ্র্যানডলি ক্লাবে। শুধু আমি নই, আমাদের পরিবারের সবাই এই ক্লাবে কখনো না কখনো খেলেছে। আমার বাবা ছিলেন ক্লাবের কোচ। রোববার সারা দিন কাটত গ্র্যানডলির সঙ্গে। পুরো পরিবার মিলে খেলতাম। হয়তো আমি খেলছি, বিপক্ষ দলে বড়দের মধ্যে আমার চাচাও আছেন। এভাবেই কেটে যেত সারা দিন।

তখন একেক দলে সাতজন করে খেলত। রোসারিওর অন্যান্য পাড়ার দলের সঙ্গে আমরা ম্যাচ খেলতাম। প্রথম ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম আমার দাদির কারণে। গ্র্যানডলির দলে আমার মতো ছোট্ট ছেলের জায়গা ছিল না। একদিন বড় একজনকে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে দাদি আমাকে এগিয়ে দিলেন। কোচ শুরুতে রাজি ছিলেন না, পরে আপত্তি করেননি।

যখন আমি আমার সমবয়সীদের সঙ্গে খেলা শুরু করলাম, তখন কোচ হিসেবে বাবাকে পেলাম। সারাটা দিন ব্যয় করতাম খেলার পেছনে। স্কুলে যেতাম, ফিরেই বল নিয়ে ছুটতাম। গ্র্যানডলির মাঠে প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এসে কোনোমতে মুখে খাবার গুঁজে বেরিয়ে পড়তাম আবার। এবার খেলা জমত বাড়ির পাশের রাস্তায়। ফুটবল ছাড়া আর কিছুই আমরা খেলতাম না। এমনকি ঘরেও আমার পায়ে বেশির ভাগ সময় বল থাকত। ভাইদের আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হতো না, পাড়ার ছেলেপুলেরাই আমাকে দেখে রাখত। খেলার জন্যই ওরা আমাকে চিনত। তত দিনে বয়স আট কি নয় ছুঁয়েছে। লাথি খাওয়ার ভয় তখন আর ছিল না।

সত্যি বলতে কোনো খেলোয়াড়কে আমি আমার ‘নায়ক’ ভাবিনি। সব আর্জেন্টাইনের মতো আমিও ম্যারাডোনার ভক্ত ছিলাম। বোকার হয়ে তাঁর খেলার ভিডিও দেখতাম, সেই স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। পাবলো আইমার যখন প্রথম এলেন, তাঁর খেলাও খুব ভালো লাগত। কিন্তু তাঁরা কেউ আমার আদর্শ ছিলেন না। ভাই আর কাজিনদের সঙ্গে রাস্তায় খেলে আমি বড় হয়েছি। তাদের দেখেই শিখেছি। আমার পরিবার আমাকে বাঁচার কৌশল শিখিয়েছে, কিন্তু ফুটবলের কৌশল আমি শিখেছি নিজে নিজে। 

এখন ফুটবল খুব একটা দেখি না। কিন্তু সে সময় নিয়মিত খেলা দেখতে যেতাম। বাবা-চাচা-কাজিনদের সঙ্গে রোসারিওর দুই বড় পেশাদার ফুটবল দল নিউয়েল আর ওল্ড বয়েজের ম্যাচ দেখতাম। যখন ছোট ছিলাম, আমি সব সময় একজন ফুটবলারই হতে চাইতাম। এই চাওয়া আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগত। কখনো ভাবিনি স্বপ্নটা সত্য হবে, এত প্রবলভাবে সত্য হবে! ছোটবেলায় খেলতাম স্রেফ খেলাটাকে ভালোবাসি বলে। কিন্তু আমার মনের খুব গভীরে কোথাও ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। ইচ্ছা ছিল, নিউয়েলরা যে মাঠে খেলে, একদিন আমিও খেলব।

মেসির নেতৃত্বেই বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত হলো আর্জেন্টিনার
মেসির নেতৃত্বেই বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত হলো আর্জেন্টিনার

এই ইচ্ছাটা পূরণ হলো খুব দ্রুত। গ্র্যানডলির সঙ্গে প্রায় দেড় বছর থাকার পর আমি নিউয়েলসের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলাম। নিউয়েলের সঙ্গেই প্রথম ১১ জনের দলে, বড় মাঠে খেলার অভিজ্ঞতা হলো। লম্বায় ছোট ছিলাম বলে প্রথম চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার অভিজ্ঞতাও হলো এই সময়। সমবয়সীদের তুলনায় খাটো ছিলাম। কিন্তু প্রসঙ্গ যখন ফুটবল, এই ঘাটতি কখনোই আমাকে ভাবাত না। খেলা শুরুর আগে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়েরা তাকিয়ে থাকত, একটু অস্বস্তি হতো। কিন্তু খেলা শুরু হলে যখন আমার পায়ে বল আসত, তখনই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেত।
নিউয়েল আমাকে ক্লিনিকে পাঠাল। ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, আমার শরীরে একটা অবর্ধনশীল হরমোন আছে। আমি বেড়ে উঠছিলাম, কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে ধীর গতিতে। ডাক্তার বললেন, চিকিৎসা নিলে আমি অন্যান্য ছেলেমেয়ের মতো বেড়ে উঠতে পারব। যখন চিকিৎসা শুরু হলো, তখন আমার বয়স বড়জোর ১১ কি ১২। প্রায় এক বছর চিকিৎসা নিয়েছি, বাবা সব খরচ বহন করেছেন। ইউরোপে আসার পর খরচের দায়িত্ব নিল বার্সেলোনা। যদিও আমার ইউরোপ আসার উদ্দেশ্য সেটা ছিল না।
স্পেনে যখন এলাম, তখনো আমার বয়স মাত্র ১৩। শুরুতে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণে এসেছিলাম। পরের বার ন্যু ক্যাম্পে অংশ নেওয়ার সময় পুরো পরিবার স্পেনে চলে এল। আমি যা করতে চেয়েছি, সেটাই করতে পারার সুযোগ পাওয়া একটা দারুণ ব্যাপার। অদ্ভুত আর কঠিনও বটে। আমার আগের জীবনের সঙ্গে এই নতুন জীবনের কোনো মিল ছিল না। বার্সেলোনায় যেই ছেলেদের সঙ্গে আমি প্রশিক্ষণ নিতাম, তাদের বেড়ে ওঠা আমার মতো নয়। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, যখন খুশি ঘর থেকে বের হলাম আর বন্ধুদের ডেকে রাস্তায় খেলা শুরু করে দিলাম, এমনটা এখানে সম্ভব ছিল না। এখনো আমি মনেপ্রাণে আর্জেন্টাইন, আমার স্বভাব-চরিত্র আর্জেন্টাইনদের মতো। যদিও বার্সেলোনায় বহুদিন ধরে আছি আর এখানকার জীবনের সঙ্গে থিতু হয়ে গেছি।
আর্জেন্টিনা থেকে একটা স্বভাব আমি আমার সঙ্গে এনেছিলাম, সেটা হলো পরাজয়ের প্রতি ঘৃণা। পরাজয়; সেটা যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন, আমি মানতে পারি না। মাঠে সব সময় উজ্জীবিত থাকি। এখন মনে হয়, ছোটবেলায় আমরা যখন রাস্তায় ফুটবল খেলতাম, তখন ভাই-কাজিনরা মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করে হেরে যেত। তারা আমাকে জিতিয়ে দিত, কারণ জানত, আমি হেরে গেলে তাঁদের কপালে দুঃখ আছে। ১৩ বছর বয়সে যখন এখানে খেলা শুরু করলাম, তখনো আমি হার মানতে চাইতাম না। সতীর্থরা যখন হেরে গিয়েও মেনে নিত, আমার কাছে খুব অবাক লাগত।
গ্রীষ্মের ছুটিতে, বড়দিনে কিংবা জাতীয় দলের সঙ্গে এখনো সুযোগ পেলেই রোসারিওতে যাই। ব্যারিওর পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। সেখানকার ছেলেমেয়েদের দিনগুলো অবশ্য বদলে গেছে। এখন মা-বাবাকে ছেলেমেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়। মাঝেমধ্যে ছেলেবেলার সেই দিনগুলো মিস করি। বন্ধুরা যখন বলে, ‘আমরা ঘুরতে যাচ্ছি, তুমিও চলো।’ অধিকাংশ সময় আমাকে বলতে হয়, ‘না, কাল ম্যাচ আছে।’ কিন্তু এ নিয়ে আমার আফসোস নেই। কারণ, এই জীবনই তো আমি চেয়েছিলাম। আমি সুখী, কারণ সব বাদ দিয়ে আমি ফুটবল খেলতেই চেয়েছি। আমি যেহেতু খেলতে ভালোবাসি, এটা আমার কাছে ‘কাজ’ মনে হয় না। এখনো সেই একই রকম আনন্দ নিয়ে খেলি, যেভাবে সেই ছোট্টবেলায় খেলতাম।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ:
মো. সাইফুল্লাহ, সূত্র: স্পোর্টথ্রিসিক্সটি