৩৫ মিনিটে 'যুদ্ধজয়'

মাহমুদুল হাসান। ছবি: খালেদ সরকার
মাহমুদুল হাসান। ছবি: খালেদ সরকার

এক ঘণ্টার পরীক্ষা। ১০০টি প্রশ্ন। ৩৫ মিনিটেই উত্তর করা হয়ে গিয়েছিল মাহমুদুল হাসানের। বাকি ২৫ মিনিট হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন তিনি। কেমন লাগছিল তখন? টানা তিন মাস বিনিদ্র রাত কেটেছে এই পরীক্ষার জন্য। কত ভাবনা, আলোচনা, দুশ্চিন্তা, স্বপ্ন, পরিশ্রম, প্রস্তুতি—সব এই এক ঘণ্টার জন্য। সেই পরীক্ষা কিনা নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই শেষ হয়ে গেল? ক্লান্তি আর শান্তির একটা মিশ্র অনুভূতি টের পাচ্ছিলেন মাহমুদুল হাসান। তখনো জানতেন না, সারা দেশের ৮০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীকে পেছনে ফেলে মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় তিনি প্রথম হতে যাচ্ছেন!

গত বৃহস্পতিবার মাহমুদুলের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ঢাকায়, তাঁর খালার বাসায় বসে। একে একে আত্মীয়স্বজন আসছেন, শুভকামনা জানাচ্ছেন। মিষ্টির গন্ধে ম-ম করছে পুরো ঘর। শান্ত, স্বল্পভাষী মাহমুদুলকে মনে হলো কিছুটা বিব্রত। পরীক্ষা দিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি সুযোগ পাবেন। যে কয়টা প্রশ্নের উত্তর নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন, সেগুলো নির্ভুল হলে ঢাকার কোনো মেডিকেলেই পড়তে পারবেন, সে বিশ্বাসও ছিল। কিন্তু প্রথম হয়ে যাবেন, এতটা তিনি ভাবেননি। খবরটা প্রথম কীভাবে কানে এল, সে ঘটনাটা বললেন, ‘রেজাল্টের দিন অপেক্ষা করতে করতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভেঙেছে রেজাল্ট প্রকাশের ১০ মিনিট পর। কোচিংয়ের এক ভাইয়া ফোন করে বলল, “তুমি তো প্রথম হয়েছ।” শুনে বিশ্বাস হয়নি। নিজে রেজাল্ট চেক করার পর বিশ্বাস হলো।’
মা মমতাজ বেগম অবশ্য শুরু থেকেই ছেলের ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। বললেন, ‘ইউসুফ (মাহমুদুল হাসানের ডাকনাম) ছোটবেলা থেকে ভালো ছাত্র ছিল। শিশুশ্রেণিতেও এক শতে এক শ পেত। এসএসসি, এইচএসসিতে গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছে। আমার বিশ্বাস ছিল ও পারবে।’ বাবা মো. লুৎফর রহমান সেনাবাহিনীতে আছেন। মাহমুদুল হাসান পড়েছেন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ইচ্ছা ছিল, বাবার মতো সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় আইএসএসবি (ইন্টার সার্ভিস সিলেকশন বোর্ড) থেকে বাদ পড়ে খানিকটা হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর? ‘বন্ধুরা অনেকেই আর্মিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল, তখন একটু দুশ্চিন্তায় পড়লাম। ক্যাডেট কলেজের একটা মান আছে, সেই মান তো রাখতে হবে। আমি যদি একটা ভালো কিছুতে সুযোগ না পাই, কোন মুখ নিয়ে আবার কলেজে যাব। ছোটবেলায় ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। আর্মিতে যখন হলো না, তাই তখন ছোটবেলার স্বপ্নপূরণের জন্য চেষ্টা শুরু করলাম।’
উচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার আগে থেকেই মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার জন্য একটু একটু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি। পরীক্ষার আগে সারা রাত ধরে পড়েছেন। মাহমুদুল হাসান বলছিলেন, ‘একেকজনের পড়ার একেক স্টাইল থাকে। রাতের বেলা চারপাশ যখন নীরব হয়ে যায়, আমার তখন পড়ায় মন বসে ভালো। দিনের বেলায় আমি খুব বেশি পড়তাম না। ঘুমাতাম, কোচিংয়ে যেতাম, মডেল টেস্ট দিতাম। সন্ধ্যা থেকে একদম ভোর পর্যন্ত পড়তাম। মা রাতের বেলায় কফি বানিয়ে দিত।’ সঙ্গে যোগ করলেন মা মমতাজ বেগম, ‘ছেলে একটু পড়া থেকে উঠলে বা বাথরুমে গেলেই আমার ঘুম ভেঙে যেত। মনে হতো, ওর কিছু লাগবে কি না...।’ মো. লুৎফর রহমান তাই কৃতিত্ব ভাগ করে দিলেন দুজনকে। বললেন, ‘সব কৃতিত্ব ছেলে আর তার মায়ের।’
ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়াই যে সব নয়, এই বাস্তবতা মাহমুদুল হাসান জানেন। সামনে আরও অনেক কঠিন পথ বাকি। এমবিবিএস পাস করে তিনি নিউরোসায়েন্স নিয়ে পড়তে চান। যাঁরা মেডিকেলে সুযোগ পাননি, মাহমুদুল মনে করেন তাঁদের স্বপ্নভঙ্গ হলেও আশাভঙ্গের কোনো কারণ নেই। বললেন, ‘অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, অনেকগুলো পড়ার বিষয় আছে দেশে। যে প্রথম হয়নি, মেডিকেলে চান্স পায়নি, তার জন্য নিশ্চয়ই আরও ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। আমার একটা কাছের বন্ধু চান্স পায়নি। ওকেও একই কথা বললাম।’
পড়ালেখার পাশাপাশি মাহমুদুল হাসানের আগ্রহ বই পড়া আর ফুটবল খেলায়। ক্যাডেট কলেজে নিয়মিত ফুটবল খেলেছেন। মিডফিল্ডার ছিলেন। সামনের দিনগুলোতেও পড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা তাঁর চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা। ক্যাম্পাসের পাঠাগারে যত গল্পের বই ছিল, প্রায় অর্ধেকই নাকি পড়া হয়ে গিয়েছিল। সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রিয় লেখক। আর প্রিয় খেলোয়াড়? লিওনেল মেসি। কী আশ্চর্য দেখুন! কাকতালীয়ভাবে আজ প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে প্রিয় খেলোয়াড়ের পাশেই মাহমুদুলের ছবিটা ছাপা হলো!