সাইকেলে শাহপরীর দ্বীপ থেকে বাংলাবান্ধা

এলিজা আহমেদ
এলিজা আহমেদ

এলিজা আহমেদ ভাবছিলেন, দুর্গাপূজার ছুটিটা কীভাবে কাটানো যায়। গত মাসের কথা। তাঁর বন্ধুদের অনেকেই তখন পূজার ছুটিতে বেরিয়ে পড়েছেন। এলিজা বাসের টিকিট কেটে ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে বেরিয়ে পড়লেন, তবে তিনি একাই। গন্তব্য কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা। সঙ্গে নিলেন তাঁর ট্রেক ৬৫০০ মডেলের সাইকেল। পরদিন টেকনাফ পৌঁছেই সাইকেলটিতে চেপে বসেন তিনি। দুপুর তখন ১২টা ৪০ মিনিট। ২৮ সেপ্টেম্বর শাহপরীর দ্বীপ থেকে শুরু হওয়া এলিজার এ যাত্রা শেষ হয় ৬ অক্টোবর বেলা ১১টা ৯ মিনিটে। প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পথ একা পাড়ি দিয়ে তিনি বাংলাবান্ধা পৌঁছান।

এই যাত্রা কেমন ছিল? এককথায় এলিজা বললেন, ‘পুরো ভ্রমণটাই বেশ উপভোগ করেছি।’ শাহপরীর দ্বীপ থেকে এলিজা যখন যাত্রা শুরু করেন, আকাশে তখন মেঘ উঁকি দিচ্ছিল। পথ একটু পাড়ি দিতেই বৃষ্টি শুরু হয়। আর এমন অবস্থায় সাইকেল চালানো থামাননি তিনি। তাঁর ভাষায়, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সাইকেল চালিয়ে তিনি যখন কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কে পৌঁছান, এই যাত্রা তখন বেশ রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছিল। তবে সে অনুভূতি বেশিক্ষণ থাকেনি। তখনো তিনি জানতেন না, কী অপেক্ষা করছে সামনে। সেদিন সূর্য যখন ডোবে, তখনো এলিজা মেরিন ড্রাইভ সড়কে। এরপর সঙ্গে থাকা বাতি জ্বালিয়ে যাত্রা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু পথে চার্জ শেষ হয়ে গেলে বাতি নিভে যায়। কক্সবাজার শহর থেকে তিনি তখনো প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে। এরপর আলো ছাড়াই সাইকেল চালিয়ে সেদিন রাত সাড়ে ১০টায় কক্সবাজার শহরে পৌঁছান। এই সময় কিছুটা ভয় কাজ করছিল বলে জানান এলিজা। তবে এই পথ পেরোনোটা নাকি তাঁর জন্য বেশ অ্যাডভেঞ্চারের মতো ছিল।

শাহপরীর দ্বীপ থেকে এলিজা আহমেদের সাইকেলযাত্রা শুরু হয় l ছবি: সংগৃহীত
শাহপরীর দ্বীপ থেকে এলিজা আহমেদের সাইকেলযাত্রা শুরু হয় l ছবি: সংগৃহীত

এলিজা জানান, ওই রাতে কক্সবাজারে থেকেছিলেন তিনি। পরদিন সকালে আবার যাত্রা শুরু করেন। নয় দিনের এই যাত্রায় তাঁকে আটটি জায়গায় রাত কাটাতে হয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায়ই ওই সব অঞ্চলের সাইক্লিস্টরা থাকার জন্য সহযোগিতা করেছেন। কোথাও কোথাও আবার সাইক্লিস্টরা পথে এগিয়ে দিয়েছেন। কোথাও আবার অভ্যর্থনা দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন। বিষয়টা পরিষ্কারও করলেন। র‍্যাম্বল রাইডার্স নামের একটি সাইক্লিস্ট দলের সঙ্গে যুক্ত তিনি। যাত্রা শুরুর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ওই দলের অনেকে র‍্যাম্বল রাইডার্সের ফেসবুক পেজে পোস্ট দেন। তারপর সারা দেশের সাইক্লিস্টরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন এবং তাঁদের এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় যেকোনো সহায়তা কিংবা দেখা করতে চান সেসব সাইক্লিস্ট।

উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার পথ পাড়ি দিতে ও রাতে থাকার ব্যাপারে ‘হিমু পরিবহন’-এর সদস্যরা তাঁকে বেশ সহযোগিতা করেছেন বলে জানান তিনি। ৮০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ায় ৫ অক্টোবর রংপুরে এলিজাকে সংবর্ধনা দেয় স্থানীয় নাট্যসংগঠন ‘বিকন নাট্যকেন্দ্র’।

পুরো যাত্রাটা যে একেবারে খুব মসৃণ ছিল, তা একেবারে নয়। পথে কিছুটা বাধা-বিপত্তিও এসেছে। যাত্রার প্রথম চার দিনে টেকনাফ থেকে গাজীপুর পর্যন্ত পথ পাড়ি দিতে প্রতিদিনই তাঁকে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে। এ জন্য পরের দিন জ্বরে ভুগেছিলেন তিনি। বললেন, ‘দু-একটা বাজে অভিজ্ঞতাও ছিল। তবে  এসব ঘটনা ছাপিয়ে গেছে রাস্তায় মানুষেরা যেভাবে আমাকে উৎসাহ করেছে তাতে। বিশেষ করে উত্তর অঞ্চলে অনেকেই উৎসাহ জুগিয়েছেন আমার এমন পদক্ষেপ দেখে।’ তবে একটা বিষয় নাকি তাঁকে এখনো হাসায়। টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত আসতে অনেকে নাকি তাঁকে ইংরেজিতে বলেছেন, ‘আর ইউ ফরেনার?’ কেউ কেউ আবার রোহিঙ্গা কি না তাও জিজ্ঞেস করেছেন।

যাত্রা শেষে বাংলাবান্ধায়
যাত্রা শেষে বাংলাবান্ধায়

বগুড়ার মেয়ে এলিজা শখের বশে সাইকেল চালানো শেখেন ২০১১ সালে। সে সময় বগুড়ার শেরপুরে থাকতেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ২০১৩-এ ঢাকায় এসে যানজটের কারণে সাইকেল ব্যবহার করা শুরু করেন। এর মধ্যে ২০১৪-এর ডিসেম্বরে যুক্ত হন র‍্যাম্বল রাইডার্স নামের একটি সাইক্লিস্ট দলের সঙ্গে। তারপর থেকে ওই দলের সদস্যদের সঙ্গে সাইকেল চালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরেন। অংশ নেন বিভিন্ন ইভেন্টে। দ্য ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশে কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিং (সিএমএ) বিষয়ে পড়ছেন তিনি।

তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই যাত্রা থেকে নতুন কোনো কিছু শেখা কিংবা অভিজ্ঞতা হয়েছে কি না? ‘রাস্তার পাশে প্রচুর গাছ লাগানো উচিত।’ পরিবারের সহযোগিতা না পেলে পরিবারের বড় মেয়ে এলিজার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব হতো না। মা-বাবা ও ছোট দুই ভাইবোন সব সময় সমর্থন দিয়েছেন। তাই তো পাখির মতো উড়ে বেড়াতে পারছেন এলিজা।