আফফানের লক্ষ্য এবার ফর্মুলা ওয়ান

স্পেনের ‘সার্কিট দ বার্সেলোনা-কাতালোনিয়া’ ট্র্যাক। মোটর দৌড়ের (কার রেসিং) জন্য প্রস্তুত চালকেরা। তীক্ষ্ণ নজর সামনে, হাত স্টিয়ারিংয়ে। গড়গড় আওয়াজ তুলছে ইঞ্জিন। অপেক্ষা সংকেতের। সংকেত পেতেই ছুট। টাস টাস শব্দে মুহূর্তেই বদল হচ্ছে গিয়ার। একেকটি এলএমপি গাড়ি (স্পোর্টস কার) ছুটছে তীব্র গতিতে। গতির পারদ শুধুই ঊর্ধ্বমুখী। স্পিডোমিটারের কাট ছাড়িয়ে যাচ্ছে ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটারের ঘরও। নানা বাঁক পেরিয়ে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারের পথ শেষ হয়েছে মাত্র দেড় মিনিটে। বিজয়ী চালকের মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটি শব্দ ‘ওয়াও’।

বিদেশি রেসিং ট্র্যাকে ‘ওয়াও’ বলা বিজয়ী চালক কিন্তু বাংলাদেশি এক তরুণ। নাম আফফান সাদাত। সদ্য এইচএসসি পাস করা বছর উনিশের এই তরুণের সখ্য এখন গতির সঙ্গেই। তবে ওপরে যা বললাম তা ছিল প্রতীকী। আরও একটু ব্যাখ্যা করলে আফফানের রেসিং সিমুলেটরে (প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র) অনুশীলনের চিত্র ছিল এটি। চালকের আসন, গিয়ারবক্স, অ্যাকসিলারেটর, ব্রেক সবই আসল—শুধু ট্র্যাকটি ৫৫ ইঞ্চির টিভি পর্দায়।

ভারতের তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরের রেসিং ট্র্যাকে আফফান সাদাত। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরের রেসিং ট্র্যাকে আফফান সাদাত। ছবি: সংগৃহীত

১৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের অক্সিজেন এলাকার বাসায় গিয়ে দেখা যায় আফফানের নিজস্ব এক জগৎ। ফ্ল্যাটের দুটি ঘর তাঁর জন্য বরাদ্দ। এর মধ্যে একটি তাঁর অনুশীলনের জন্য, অন্যটি শোবার ঘর। দুটি ঘরের সবখানেই রেসিংয়ের সরঞ্জাম আর বিজয়ের নানা স্মারক। শোবার ঘরের বেশির ভাগ জুড়ে খেলনা স্পোর্টস কার। অবসরে রিমোট-নিয়ন্ত্রিত এসব গাড়ি সঙ্গ দেয় আফফানকে।

মোটর কার রেসার আফফান এরই মধ্যে নাম কুড়িয়েছেন বিশ্ব দরবারে। গত সেপ্টেম্বর মাসে ভারতে অনুষ্ঠিত ‘ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপ ২০১৭’ কার রেসিং প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছেন বাঘা বাঘা চালকদের পেছনে ফেলে। শুধু তা–ই নয়, পেয়েছেন আরও একটি খেতাব—‘পোডিয়াম ফিনিশার’। মোটর দৌড়ের চালকদের জন্য খেতাবটি মর্যাদাপূর্ণ।

ভারতে বিজয়মঞ্চে
ভারতে বিজয়মঞ্চে

ভারতের ফেডারেশন অব মোটর স্পোর্টস করপোরেশন এই টুর্নামেন্টের আয়োজক। চেন্নাইয়ের মাদ্রাজ ও তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরের বিভিন্ন ট্র্যাকে চার মাসব্যাপী চলে প্রতিযোগিতার নানা ধাপ। অংশ নেন বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, চীনসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানের ২২ জন মোটর স্পোর্টসচালক। এতে প্রথম হয়েছেন ভারতের দিল্লির কারমিন দার সিং, দ্বিতীয় চেন্নাইয়ের সন্দ্বীপ কুমার। এই প্রতিযোগিতা হয় ‘টোরিং কার’ ক্যাটাগরিতে (ফর্মুলা ফোর)। চালকেরা ১৮০০ সিসির গাড়ি (কার) নিয়ে ট্র্যাকে নামেন। প্রতিযোগিতা শুরু হয় জুলাই মাসে। প্রথম ধাপ ছিল কোয়েম্বাটুরের চেত্তিপালায়ন এলাকায়। প্রতিটি ট্র্যাক ছিল ২ দশমিক ১ কিলোমিটারের। সেটিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ের রেস হয় মাদ্রাজের ইরনগাটো গোটা এলাকায়। এখানকার ট্র্যাক ছিল ৩ দশমিক ৭৬ কিলোমিটারের। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে তিনি জুনিয়রদের মধ্যে রানারআপ হন। ১৭ সেপ্টেম্বর একই ট্র্যাকে অনুষ্ঠিত হয় সর্বশেষ ধাপ। অংশ নেন সিনিয়র-জুনিয়র সবাই। এতেই বাজিমাত করেন তিনি। ১ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডে শেষ করেন রেস, যেখানে ছিল ১৬টি বাঁক। তৃতীয় হয়ে তাক লাগিয়ে দেন অন্যদের।

আফফান বলেন, ‘পোডিয়ামে (মঞ্চে) যখন দাঁড়িয়েছি, আমার হাতে লাল-সবুজ পতাকা। এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কী হতে পারে!’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন আরেক বাংলাদেশি—ঢাকার অভিক আনোয়ার।

পুরস্কার হাতে আফফান সাদাত। ছবি: সৌরভ দাশ
পুরস্কার হাতে আফফান সাদাত। ছবি: সৌরভ দাশ

চালকের আসনে আফফান

আফফানের বাবা মিখাইল সাদাত শরীফুল ইসলাম একসময় ছিলেন গাড়ির আমদানিকারক। নানা মডেলের গাড়ি দেখতে দেখতে পাঁচ বছর বয়স থেকেই গাড়ির সঙ্গে সখ্য আফফানের। আফফান বললেন, ‘প্রথম দিকে লুকিয়ে গাড়ি চালাতাম। একদিন ধরা পড়ি মায়ের হাতে। খবর চলে গেল বাবার কানে। তারপর পিটুনি।’

একসময় আফফানের মাথায় চাপে রেসিংয়ের ‘ভূত’। এবার অন্য পরীক্ষা। ইউটিউবসহ নানা ভিডিও দেখে নিজেকে পোক্ত করতে থাকেন। মা-বাবা খেয়াল করেন, ছেলে নাছোড়। শেষমেশ ছেলের ইচ্ছাপূরণে হাত বাড়ান। তবে নিজে নিজে পোক্ত হলে তো রেসিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া যায় না, লাগবে রেসিং লাইসেন্স। সেই ধাপ পেরোতে আফফান যান যুক্তরাজ্যে। ২০১৫ সালে মোটর স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন অব ইউকে থেকে রেসিং লাইসেন্স পান। কিন্তু যুক্তরাজ্যে খেলা খুবই ব্যয়বহুল। এরপর ২০১৬ সালে ভারতে খেলার জন্য নেন সে দেশের ফেডারেশন অব মোটর স্পোর্টস করপোরেশনের লাইসেন্স।

রেসিং সিমুলেটরে চলছে আফফানের অনুশীলন। ছবি: ছুটির দিনে
রেসিং সিমুলেটরে চলছে আফফানের অনুশীলন। ছবি: ছুটির দিনে

লক্ষ্য এখন ফর্মুলা ওয়ান

মোটর কার রেসিংয়ের বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ধাপ ‘ফর্মুলা ওয়ান’। অবশ্য আফফান পাকাপোক্ত খেলোয়াড় হিসেবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রথম অংশ নেন ফর্মুলা ওয়ান ট্র্যাকেই। ২০১৬ সালের অক্টোবরে ‘ভক্সওয়াগন ভেন্টো কাপ’ নামের টুর্নামেন্টটি হয় দিল্লির নয়দায়। বুদ ইন্টারন্যাশনাল সার্কিট ট্র্যাকে লড়াই করেন। ৫ দশমিক ৪২ কিলোমিটার ট্র্যাক শেষ করেন ২ মিনিট ৩০ সেকেন্ডে। সেবার তাঁর অবস্থান ছিল সাত নম্বরে।

আফফান বলেন, এখন পুরোদমে ফর্মুলা ওয়ানের অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছি। এ জন্য সিমুলেটরে খেলছি সিলভার স্টোন ইউকে, বিয়ার এনও চেক রিপাবলিক ও সার্কিট ডি বার্সেলোনা ট্র্যাকে। প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা কাটছে সিমুলেটরে। ইচ্ছা রয়েছে রেসিংয়ের ‘টোরিং কার’ ক্যাটাগরিতে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতা ‘লি ম্যানস কাপে’ অংশ নেওয়ার।

প্রস্তুতি পর্ব চলছে ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারবেন তো? আফফানের উত্তর, ‘ফর্মুলা ওয়ান আমি জিততে পারব। মূল সমস্যা এখন পৃষ্ঠপোষকতা। কারণ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত কার রেসে অংশ নেওয়া খুবই ব্যয়বহুল। পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এগোনো কঠিন।’

তবে আফফান আশাবাদী। বললেন, ‘আমার বিশ্বাস সাড়া পাব।’ বাবা মিখাইল সাদাত শরীফুল ইসলাম ও মা লায়লা বেগমও ছেলের স্বপ্নপূরণের অপেক্ষায় আছেন।

গাড়িতে রেসিংয়ের জন্য প্রস্তুত আফফান
গাড়িতে রেসিংয়ের জন্য প্রস্তুত আফফান

সঙ্গী তাঁর কমলা গাড়ি

সিমুলেটরে অনুশীলনের পাশাপাশি টয়োটা স্টারলেট স্পোর্টস কার নিয়েও বেরিয়ে পড়েন আফফান। চট্টগ্রামে রেসিং করার মতো জায়গা নেই। ফাঁকা সড়কেও খুব বেশি গতি তোলেন না। আমাদের অনুরোধে তাঁর গাড়ি নিয়েই ছবি তুলতে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান।

ছবি তোলার ফাঁকে আফফান বলেন, ‘আমার আরেকটি স্বপ্ন আছে। বাংলাদেশি দক্ষ মোটর স্পোর্টসচালকদের বিশ্বদরবারে পরিচয় করানো। এ জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনের টুর্নামেন্টে অংশ নিতে আগ্রহীদের আমি সহায়তা করতে চাই।’

ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা আফফান কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হতে যাচ্ছেন। প্রায় গুছিয়ে এনেছেন সবকিছু। সেখানে গিয়ে মন্ট্রিল ও টরন্টোর ট্র্যাকগুলোতে খেলার ইচ্ছা তাঁর। দৃঢ়তার সঙ্গে আফফান বলেন, ‘যেখানেই থাকি, রেসিং থাকবেই।’ এতেই তো তিনি খুঁজে পান প্রেরণা।