পড়ছি, ব্যবসাও করছি

সারা বিশ্ব এখন উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বানে সরব। ‘চাকরি করব না, চাকরি দেব’ এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রাবস্থায়ই অনেক শিক্ষার্থী নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে বসছেন। চলুন, এমন কয়েকজনের গল্প শোনা যাক।
বাঁ থেকে নবনীতা ও সামিয়া
বাঁ থেকে নবনীতা ও সামিয়া

গ্রাম্পি ফিশ স্রেফ শখে গড়া নয়

সামিয়া বিনতে আলমগীর, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [সহপ্রতিষ্ঠাতা, গ্রাম্পি ফিশ]

বন্ধুর জন্মদিনে তাঁকে চমকে দেওয়ার জন্য একটা টি-শার্ট বানাতে গিয়ে আমাদের শুরু। ‘আমাদের’ বলতে আমি আর আমার বন্ধু নবনীতা রায়। দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করছি। শুরুর দিকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা টি-শার্ট বানাতাম। একবার আমার বিভাগের পিকনিকের জন্য প্রায় ৮০০ টি-শার্টের অর্ডার পেলাম। এভাবেই আস্তে আস্তে জন্ম হলো ‘গ্রাম্পি ফিশ’-এর।

ভেবে দেখলাম, অনেকেই নিজের পছন্দমতো একটু অন্য ধাঁচের টি-শার্ট পরতে চান। গ্রাম্পি ফিশ নামের ফেসবুক পেজটির মাধ্যমে আমরা প্রথম দিকে বিদেশি ‘টিভি সিরিজ ভক্তদের’ জন্য টি-শার্ট বিক্রি করতাম। যেমন গেম অব থ্রোনস, ফ্রেন্ডস। পরের দিকে আমাদের টি-শার্টে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন চরিত্র, যেমন ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কাকাবাবু...তারাও গুরুত্ব পেতে শুরু করল। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে টি-শার্টের কাপড় ঠিক করা, কারখানায় দেওয়া, নিজেদের পছন্দমতো নকশা বসানো, গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া—সহজ ছিল না মোটেও। বন্ধুরা খুব সাহায্য করেছে। শিক্ষকদের কাছ থেকেও ভীষণ অনুপ্রেরণা পেয়েছি। ক্লাসে শিক্ষকেরা অনেক সময় বিভিন্ন বিষয় পড়াতে গিয়ে দাঁড় করিয়ে বলেন, ‘তুমি বলো। তোমার তো নিজের ব্যবসা আছে।’ পড়ার বিষয়গুলো প্রতিনিয়ত কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে গিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে। পাঁচ বছর চাকরি করলেও বোধ হয় এত অভিজ্ঞতা হতো না।

গ্রাম্পি ফিশ স্রেফ শখে গড়া নয়। আমাদের প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন আছে। অনেক বড় পরিকল্পনা আছে। স্বপ্ন দেখি, একদিন দেশের বাইরেও গ্রাম্পি ফিশের সুনাম ছড়াবে।

অহিদুজ্জামান
অহিদুজ্জামান

নিজেই খিচুড়ি রান্না করি

অহিদুজ্জামান, শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি [প্রতিষ্ঠাতা, ফুডিফাই]

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে আমি প্রথমে বিবিএতে ভর্তি হই। আমাদের বিভাগের বিপাশা মতিন ম্যাডাম একবার বলেছিলেন, ‘সফল ব্যবসায়ী হতে হলে তোমার মধ্যে পাগলামি থাকতে হবে।’ এই কথাটা সব সময় আমার মাথায় ছিল। গত বছরের পয়লা বৈশাখে প্রথম ব্যবসার ভূত মাথায় চাপল। সাতজন বন্ধুর সহযোগিতা নিয়ে প্রথম পয়লা বৈশাখে রাস্তায় একটা ফলের জুসের দোকান দিলাম।

এরপর ক্যাম্পাসের মার্কেটিং ফেস্টে স্টল দিলাম। সুযোগ পেয়ে সেবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান মো. সবুর খানের কাছে আমার ব্যবসায়িক ভাবনার কথা বললাম। স্যারই আমাকে ক্যাম্পাসের একটা জায়গায় বিনা পয়সায় জুসের দোকান বসানোর সুযোগ করে দিলেন। সেখানে আমি প্রায় আট মাস জুস বিক্রি করেছি। কিন্তু ব্যবসা করতে গিয়ে তত দিনে পড়াশোনা লাটে উঠেছে। নিজেই জুস বানাতাম, আরও নানা ঝামেলা ছিল। দুই সেমিস্টার বাদ দিয়েছি। বাসায় বলতেও পারছিলাম না। ভাবছিলাম, পড়াশোনা আর বোধ হয় করা হবে না।

এই সময় একটা সুযোগ এল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপার্টমেন্ট অব এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ চালু হলো। এই বিভাগে আমি ৭৫ শতাংশ বৃত্তিতে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। বৃত্তির ঘোষণা যেদিন দেওয়া হবে, সেদিন অভিভাবককে সঙ্গে আনতে বলা হয়েছিল। আমি বাবাকে নিয়ে গেলাম। চেয়ারম্যান স্যার যখন সবার সামনে বললেন, ‘এই যে আমাদের ছাত্র অহিদুজ্জামান, সে একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক।’ বাবা তখনই প্রথম বিষয়টা জানতে পারলেন। দেখি তাঁর চোখে পানি। আমার মনে হলো, এই মুহূর্তটার অপেক্ষাতেই ছিলাম।

এখন চেয়ারম্যান স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বড় একটা জায়গা ভাড়া দিয়েছেন। আমাকে কোনো অগ্রিম টাকা দিতে হয়নি। ড্যাফোডিলের শুক্রাবাদ ক্যাম্পাসের পাশে ভালোই চলছে আমার রেস্তোরাঁ—ফুডিফাই। রেস্তোরাঁর জন্য প্রতিদিন সকালে আমি নিজ হাতে খিচুড়ি বানাই। আমার অধীনে ১০-১২ জন কর্মী আছেন। বড় দুই ভাই আছেন পার্টনার হিসেবে, তাঁরা দেখাশোনা করেন। এখন নিয়মিত ক্লাসও করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবলি শাহরিয়ার স্যার আর রাশেদুল ইসলাম স্যার আমাকে অনেক সহায়তা করেছেন।

হুমায়রা (বাঁয়ে) বিভিন্ন মেলায় অংশ নিয়ে গয়না বিক্রি করেন
হুমায়রা (বাঁয়ে) বিভিন্ন মেলায় অংশ নিয়ে গয়না বিক্রি করেন

শিক্ষার্থী-উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতায় সেরা পাঁচে ছিলাম

হুমায়রা নূর আফসানা, শিক্ষার্থী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় [প্রতিষ্ঠাতা, গয়নার বাক্স বিডি]

শুরুটা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট গণ্ডির ভেতর। আমার ভাই অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন, তাঁর মাধ্যমে অল্প অল্প করে বিদেশ থেকে কিছু গয়না এনে বন্ধুদের কাছে বিক্রি করতাম। এ ছাড়া দেশের বাইরে থেকে কেউ এলে তাঁদের মাধ্যমে অল্প অল্প করে গয়না আনাতাম। গয়নার বাক্স বিডি নামে একটা ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে পরিচিতজনেরা আমার কাছ থেকে গয়না কিনত। এরপর যখন আস্তে আস্তে অর্ডার বাড়তে লাগল, বন্ধুরা বলল, একটা ফেসবুক পেজ খুলে ফেলতে। তখন থেকেই চালু হলো আমার পেজ—গয়নার বাক্স বিডি। এখন ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ আমার পেজটা অনুসরণ করে। গড়ে প্রতিদিন ১০টি অর্ডার পাই।

পুরান ঢাকা ঘুরে আমি দেশি গয়না সংগ্রহ করি। সেগুলোর ছবি ফেসবুকে আপলোড দিই। দেশের বাইরে থেকেও গয়না আনি আলি এক্সপ্রেস বা অ্যামাজনের মাধ্যমে। খুব বেশি লাভ করতে চাই না। গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ুক, এটাই চাওয়া। গত বছর ‘গ্লোবাল স্টুডেন্টস এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ অ্যাওয়ার্ড’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। এই প্রতিযোগিতা প্রথমে জাতীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তারপর একজনকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত করা হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যেতে পারিনি, কিন্তু আমি সেরা পাঁচে ছিলাম। এটা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে আরও। আমি বিভিন্ন মেলায় অংশ নিই, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে স্টল দিই। এভাবেও গয়নার বাক্স বিডি খানিকটা পরিচিতি পেয়েছে।

আমি বায়োটেকনোলজির ছাত্রী। পড়াশোনায় কখনোই অতটা ভালো ছিলাম না। ব্যবসা করতে গিয়ে সিজিপিএও খানিকটা কমে গেছে। কিন্তু ব্যবসার প্রতিই আমার আগ্রহ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট থেকেও খুব সহায়তা পেয়েছি।

শুরুতে কত কষ্ট করতে হয়েছে! নিজেই রিকশা দিয়ে এখানে-ওখানে গিয়ে ডেলিভারি দিয়ে আসতাম। নইলে বন্ধুদের অনুরোধ করতাম, ‘দোস্ত, একটু দিয়ে আয়।’ এখন একটা কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানির সঙ্গে আমার চুক্তি হয়েছে। তিনজন লোকও রেখেছি, তারা গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেন। দেশি গয়নাকে আমি সারা বিশ্বে পরিচিত করতে চাই। ভাইয়াকে প্রায়ই বলি, আমি চাই একদিন অস্ট্রেলিয়াতেও গয়নার বাক্স বিডি এক টুকরো জায়গা পাবে।

ঝুঁকি নিতেই হবে

ছাত্রজীবনেই ব্যবসার পরিকল্পনা শুরু করা উচিত বলে মনে করেন দেশের অনেক উদ্যোক্তা। বিডি জবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘আমাদের এখানে ডিগ্রি নিতেই জীবনের ২৩-২৪ বছর পার হয়ে যায়। ভিন দেশের তরুণেরা কিন্তু আরও আগে থেকেই পেশাজীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করে। ছাত্রজীবনে ব্যবসা শুরু করলে পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি একটা বাস্তব জ্ঞান অর্জন করা যায়। কয়েকজন বন্ধু মিলে শুরু করতে পারলে ভালো। কেউ হয়তো বিপণনে ভালো, কারও আবার প্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে—এ রকম একেক দক্ষতার মানুষ মিলে একটা ব্যবসা শুরু করলে সুবিধা হয়।’

রায়ানস কম্পিউটারস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ হাসান বলছিলেন, ‘আমি তো মনে করি ছাত্রজীবনে যে শুরু করতে না পারবে, তার জন্য সফল ব্যবসায়ী হওয়া কঠিন। ব্যবসায় ঝুঁকি থাকবেই, কিন্তু ঝুঁকিটা নিতে হবে।’ ঝুঁকি প্রসঙ্গে ফাহিম মাশরুরের বক্তব্য, ‘ভুল থেকেই তো মানুষ শেখে। ছাত্রজীবনে না শিখলে শিখবে কখন? ব্যবসা আর পড়ালেখা, দুটো সমানতালে চালিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বরং ব্যবসার ঝুঁকির চেয়ে বড়। কারও যদি বিশ্বাস থাকে যে আমি দুটোর সমন্বয় ঠিকভাবে করতে পারব, তার উচিত দেরি না করে শুরু করে দেওয়া।’