একজন বাবার গল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কিছুদিন আগে এক মেয়ের ই-মেইল পেলাম। দুই বোন এবং বাবা-মায়ের সংসারে সে বড় মেয়ে। সে আমাকে লিখেছে একটা বিপদের কথা। তার ঘুম ভেঙেছে বাবার হাতে মায়ের মার খাওয়ার শব্দে। ছোটবেলা থেকে নাকি এভাবেই অনেকবার তাদের দুই বোনের ঘুম ভেঙেছে। আগে কখনো প্রতিবাদ না করলেও এবার মেয়েটা অসুস্থ মা আর বোনকে নিয়ে একটা আবাসিক হোটেলে উঠেছে। এরপর কী করবে জানে না। মেয়েটা অনেক মানসিক কষ্ট থেকে এই চিঠিখানা আমাকে লিখেছে। শেষে লিখেছে, আমার এসব কথা শোনার কোনো মানুষ নেই। আমি তাকে অনেক কথার মধ্যে যেটা বলতে চেয়েছি তা হলো, মেয়েটার মা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং মেয়েটির আইনি সহায়তা নেওয়া দরকার। মেয়েটি এরপর আমার সঙ্গে এখনো পর্যন্ত যোগাযোগ করেনি। মেয়েটি শেষমেশ কী করেছে, তা আমি এখনো জানি না।

এই গল্পের মধ্যে একজন বাবার কথা বলা আছে। আমরা ধরে নিতে পারি, মেয়েটি যদি ছোটবেলা থেকে দেখত, তার মা অন্য কোনো পাড়ার অসভ্য ও অচেনা লোকের নির্যাতনের শিকার, তার মধ্যে হয়তো এতটুকুও দ্বিধা থাকত না আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু মেয়েটি এত দিন ধরে সহ্য করেছে, কারণ নির্যাতক চরিত্রটি তার নিজের বাবা। বাবার বিরুদ্ধে মেয়েটি দাঁড়াতে পারছে না। সমাজের সামনে বাবার নিকৃষ্ট দিকগুলো প্রকাশ করে দিতেও মেয়েটি দ্বিধা করছে, কেননা এটাকে সে তার নিজের লজ্জা বলেও ভাবছে। এ ছাড়া বাবার সঙ্গে সন্তান হিসেবে তার যেই সম্পর্ক, সেই সমীকরণেও তার নিজস্ব কিছু না পাওয়ার ব্যাপার আছে, যে কারণে আবেগের জায়গা থেকে বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তার জন্য যথেষ্টই কঠিন।

এই মেয়েটির গল্পের বাবার মতো আমাদের সমাজে অনেক বাবা আছেন। প্রশ্ন হলো, বাবা শব্দটির ওপর আমরা যেই পবিত্রতা দিয়েছি, সেটা এ রকম বাবাদের ক্ষেত্রে কতটুকু কার্যকরী?œবাবা কি এমন কোনো স্বতঃসিদ্ধ পবিত্র চরিত্র, যাকে কোনো দিনও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না, সে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অর্থে যতই অত্যাচারী, পলায়নপর, দায়িত্বহীন, এমনকি আইনি দৃষ্টিতেও অপরাধী হয়ে উঠুক?

পরিবার-প্রথা মনুষ্য সমাজের এবং সভ্যতার অলংকার। এ কথা কারোর অজানা নয় যে মানুষ তার নানাবিধ প্রয়োজনে পরিবার-প্রথা গড়েছে। বাবা-মা সেই পরিবারের দুই মৌলিক স্তম্ভ, যেখান থেকে একটি পরিবার শুরু হয়। সভ্যতার এই অলংকারকে পুষ্ট করতে বাবা-মায়েদের ওপর সমাজ হিসেবে আমরা যথার্থ সম্মান আরোপ করেছি। কিন্তু সেই সম্মানের জায়গা কি স্বতঃসিদ্ধ? একজন নারীর সঙ্গে পুরুষের দৈহিক মিলনের ফলে কোনো সন্তান জন্ম নিলেই কি আমরা সেই পুরুষকে স্বতঃসিদ্ধ পবিত্র বাবা হিসেবে চিরদিনের জন্য মেনে নিতে বাধ্য? নাকি একজন বাবাকে, তার জীবনের নানান পর্যায়ের নানান ধাপের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে একজন যোগ্য বাবা হয়ে উঠতে হয়? বাবা কি কোনো চরিত্র? নাকি একটি দায়িত্ব, যেটাকে যোগ্যতা দিয়ে প্রমাণ করার বিষয় আছে?

আমরা এমন অনেক কথা শুনে থাকি ছোটবেলায়—বাবা কিংবা মা কখনো ভুল করতে পারেন না! এই কথাগুলো একজন শিশুর মানসে খুব গভীরভাবে গেঁথে যায় এবং সে সেটাকে বিশ্বাসে পরিণত করে তা-ই নিয়ে বেড়ে ওঠে। কিন্তু এই বিশ্বাসের সঙ্গে বাস্তবের ছবি প্রায়ই মেলে না। সুস্থ পরিবারগুলোতে এটা কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু আমরা বাস্তবে এমন অনেক মানুষ দেখি, যাঁরা তাঁদের মা অথবা বাবার ভূমিকায় খুব একটা ভালো করতে পারেননি। সন্তানকে লালন-পালনের সমস্ত দায়িত্ব মায়ের ওপর চাপিয়ে দিয়ে অন্য কোথাও সংসার করা বাবাদের সংখ্যা এই পৃথিবীতে মোটেও কম নয়। তারপরও কি সন্তানদের পবিত্র দায়িত্ব শুধু জন্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেই এ রকম দায়িত্বহীন বাবাদের নিয়মমাফিক শ্রদ্ধা জানিয়ে যাওয়া?

সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তার ঢংকেও সমানতালে পরিবর্তন করে নিতে না পারলে যেই সুখী সমাজের লক্ষ্যে মানুষ একদিন পরিবার-প্রথা গড়েছিল, তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। বাবা-মাকে শ্রদ্ধা করার যেই শিক্ষা আমরা ছোটবেলা থেকেই দিয়ে থাকি, তার পাশাপাশি আমাদের ছেলেমেয়েদের যুগোপযোগী এমন শিক্ষাও এখনই দেওয়া দরকার যে অপরাধ হলো অপরাধ, এবং অপরাধী বাবাকে বা মাকে ভালোবাসতে বাধা নেই, কিন্তু তার অপরাধটুকুকে শ্রদ্ধা না করে তাকে আইনের মুখাপেক্ষী করতে পারলেই বরং মানুষ হিসেবে তাদের প্রতি এবং সমাজের প্রতিও আমরা আমাদের যথার্থ দায়িত্বগুলো পালনে সক্ষম হব।

লেখক: সংগীতশিল্পী