মায়েদের যুদ্ধজীবন

সন্তানকে স্কুলে দিয়ে বাইরে মায়েদের এই অপেক্ষার চিত্র প্রতিদিনের l ছবি: খালেদ সরকার
সন্তানকে স্কুলে দিয়ে বাইরে মায়েদের এই অপেক্ষার চিত্র প্রতিদিনের l ছবি: খালেদ সরকার

যাঁদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তাঁদের এক বা একাধিক সন্তান। কারও কারও দুটি সন্তানই ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী। কারও একজন ভিকারুননিসায়, অন্যজন রাজধানীর অন্য একটি স্কুলে। ‘গোল্ডেন জিপিএ’-র দৌড়ে সন্তানকে টিকিয়ে রাখতে তাঁরা যুদ্ধ করছেন। যুদ্ধে পেলেন কী, হারালেনই বা কী? দিন কাটছে কেমন? এমন সব প্রশ্নের জবাবে মায়েরা গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলেন।

ডালিয়া রহমানের দুই মেয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী। বড় মেয়ে নবম শ্রেণিতে, ছোটটি প্রথম শ্রেণিতে। দুজনই দিবা শাখার। তাই বলে বেশ অনেকটা সময় বিছানায় শুয়ে থাকার সুযোগ হয় না ডালিয়ার। তাঁর দিন শুরু ভোর পাঁচটায়। উঠেই চা বসান, রুটি বানান, ফ্রিজ থেকে মাছ বা মাংস কিছু একটা বের করে নেন। নাশতাটা খেয়েই চুলায় রান্না বসান। তারপর বনশ্রী থেকে বেইলি রোডে দুই মেয়েকে নিয়ে ছুট। বড়জোর দুটি তরকারি রান্না করে সারা দিনের জন্য। একঘেয়ে খাবার খেতে ভালো না লাগলেও উপায় নেই। মাঝে মাঝে শাক খেতে মন চায়। তখন রাতে বাড়ি ফিরেও রান্নাঘরে ঢুকতে হয়।

বেশির ভাগ দিনই ডালিয়া আর তাঁর দুই মেয়ে বনশ্রী থেকে বেইলি রোডের স্কুল ফটক পর্যন্ত রিকশায় পৌঁছাতে পারেন না। মাঝপথে নেমে সন্তানদের ব্যাগ পিঠে নিয়ে দৌড়ান। তাদের ক্লাসে ঢুকিয়ে দিয়ে তারপর এসে অভিভাবক ছাউনিতে বসেন। বিকেল পাঁচটায় স্কুল ছুটির পর মেয়েকে নিয়ে বাসায় যান। সেখান থেকে মেয়েকে নিয়ে কোচিং সেন্টারে। ছোটাছুটির শেষ রাত আটটায়। ছোট মেয়েটি বেশ ছোটই। বাড়ি ফিরে তাকে নিয়েও বসতে হয় ডালিয়াকে। এত চাপ নিচ্ছেন কেন, সন্তানকে দিচ্ছেনই বা কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ডালিয়ার জবাব, সবাই কোচিং করাচ্ছে। না করালে ভয় হয়। ক্লাসেও প্রতিযোগিতা খুব। উপায় নেই।

সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা। মায়েদের খাওয়াদাওয়া, টয়লেটের কী ব্যবস্থা? জবাবে তাঁরা বলেন, সকালের নাশতার পর একেবারে সন্ধ্যায় বাসায় গিয়ে ভাত খান। ব্যাগে পানি আনেন না। সন্তানের ব্যাগ এত ভারী, পানির বোতল দিয়ে নিজের হাতব্যাগটি আর ভারী করতে চান না। তা ছাড়া আশপাশে পরিষ্কার টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। তাই বুঝেশুনেই পানিটা একটু কম খান। অনিয়মিত খাওয়াদাওয়ায় অ্যাসিডিটি ধরেছে অনেককে। কদিন পর কিডনির সমস্যায় ভুগবেন এমন ভয়ও পান কেউ কেউ।

মায়েরা কি এই জীবনই চেয়েছিলেন? জবাবে বিবি জয়নব নামের এক নারী বলেন, তাঁর স্বামী সরকারের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। তবু তিনি মন চাইলেও একটা ভালো পোশাক পরতে পারেন না, মন চাইলেই বেড়াতে যেতে পারেন না। স্বামীর যা রোজগার, সবটাই সন্তানের পেছনে খরচ হয়। মেয়ে আইসিটি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন আর গণিতের কোচিং করেন। সপ্তাহে সাত দিনই তাঁকে নিয়ে ছোটেন। হাজার পঁচিশেক টাকা ব্যয় হয় শুধু মেয়ের জন্যই। লেখাপড়ার মতো ভালো কাজে খরচ করছেন, দুঃখ কেন? এমন প্রশ্নে বলছিলেন, মা হয়ে মেয়ের এই কষ্ট সহ্য করতে পারেন না। মেয়ে নাচ শিখতে চেয়েছিলেন, পড়ার চাপে কিছুই করতে পারলেন না। তাঁর প্রশ্ন, এত এত পড়ে শেষ পর্যন্ত কী হবে? পঞ্চম শ্রেণি, অষ্টম শ্রেণির প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নও ফাঁস হলো। এত সংগ্রামের পর আসলে ফল কী হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। ছেলেমেয়েরা একেবারে চাকরি-বাকরি করে থিতু না হওয়া পর্যন্ত জীবনযুদ্ধে জিতেছেন কি না, তা বলা যাচ্ছে না।

এই কষ্টের সঙ্গে ছোট ছোট আরও কষ্ট আছে তাঁদের। আতিকুন নাহার তাঁদের একজন। তিনি ও তাঁর অন্য দুই বোন চাকরিই ছেড়ে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। সন্তানেরা অল্প বয়সে প্রতিযোগিতা শিখছে, কিন্তু তাঁদের মতো হৃদয়বান হয়ে উঠতে পারেনি এমন দুঃখও আছে কারও কারও। একজন মা বলছিলেন, তাঁর ছেলেবেলায় বাড়িতে আত্মীয়স্বজন নিয়মিত বেড়াতে আসতেন। আত্মীয়রা চলে যাওয়ার সময় তাঁরা কেঁদে বুক ভাসাতেন। তাঁর সন্তানদের মধ্যে এই অনুভূতি দেখেন না। অবশ্য বাড়িতে তেমন মেহমান আসেনও না। এলেও খবর দিয়ে আসেন।

খাদিজা খানম নামের একজন মা বলছিলেন, ‘আমার শাশুড়ির বাড়িতে বরাবর অনেক অতিথি নিয়ে থেকে অভ্যস্ত। এখন কেউ আসতে চাইলে তিনিই বলে দেন, বউ মা বাড়ি থাকে না, নাতি-নাতনির লেখাপড়া আছে, স্কুল-কোচিং আছে।’ অনেকে স্বামীর সঙ্গেও কথা বলার সুযোগ পান না। একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, সিনেমা দেখাও এখন তাঁদের জন্য বিলাসিতা।

এই সবকিছুর বাইরেও স্বীকৃতি ও সম্মান না পাওয়ার কষ্ট আছে মায়েদের। অভিভাবক ছাউনিতে অপেক্ষারত প্রায় সব মা-ই উচ্চশিক্ষিত। সন্তানের লেখাপড়ার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন। তবু প্রায়ই শুনতে হয়, তিনি কিছু করেন না, ‘হাউসওয়াইফ’। সন্তান লেখাপড়ায় খারাপ করলেও মাঝে মাঝে গালমন্দ জোটে। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে মায়েদের। সন্তানদের বিদ্যার জাহাজ তাঁরা বানাতে চান না। তাঁরা চান বিশ্বের উন্নত দেশের মতো শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশে চালু হোক। মা আর তাঁদের শিশুরা পাক সুখী-আনন্দময় জীবন।