মা বলতেন, 'শেষ পর্যন্ত দরজি হবি!'

মনিশ মালহোত্রা। ছবি: আইএএনএস
মনিশ মালহোত্রা। ছবি: আইএএনএস

বলিউডের সিনেমায় পোশাক পরিকল্পনা করে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন মনিশ মালহোত্রা। ফিল্মফেয়ার, আইফা অ্যাওয়ার্ডসহ বহু সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন। এ বছর হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের আমন্ত্রণে একটি সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি

ধন্যবাদ হার্ভার্ড, আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। যে মানুষটা তেমন কোনো পড়ালেখা করেনি, তার জন্য এই সম্মান অনেক বড়। এমনকি ‘ডিজাইন’ নিয়েও আমার কোনো ডিগ্রি নেই। তাই ধন্যবাদ আবারও।
আমি আমার জীবনের অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলাম মুম্বাইয়ের অন্ধকার এক সিনেমা হলে, আজ থেকে বহু বছর আগে। তখন তোমাদের অনেকের জন্মও হয়নি। ছেলেবেলার একটা বড় সময় সিনেমা দেখেই কেটেছে। কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই আমার মাকে, যিনি কখনোই আমাকে নিরুৎসাহিত করেননি। মাকে আমি বলতাম, ‘তোমার এই শাড়িটা সুন্দর নয়। বরং অমুক নায়িকার শাড়ি আমার পছন্দ।’
মা বলতেন, ‘বুঝেছি, তুই আবার সিনেমা দেখে এসেছিস।’ আজ আমার কাজিনরা এখানে উপস্থিত আছে। ওরা জানে, পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে একসঙ্গে হলেই আমার একমাত্র লক্ষ্য থাকত সবাই মিলে সিনেমা দেখা।
অতএব, আমার পুরো ছেলেবেলাই ছিল সিনেমা, সিনেমা আর সিনেমা। চলচ্চিত্রের রং, পোশাক, সুর আমাকে মুগ্ধ করত। ইয়াশ চোপড়ার ঝকঝকে সিনেমাগুলো দেখতাম আর ভাবতাম, ‘আহা, এমন একটা ফাইভ স্টার হোটেলে খাওয়ার সৌভাগ্য কি আমার কখনো হবে?’ ত্রিশূল নামে একটা ছবি দেখেছিলাম। ছবির একটা গানে গলফ খেলা, ইয়োগা করা, প্রেম আর পার্টির দৃশ্য অবাক চোখে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, পর্দার বাইরে যদি এসব দেখতে পেতাম! এত বড় বড় তারকার সঙ্গে কখনো কি দেখা হবে? এই বিশাল পৃথিবীতে আমি কি কখনো আলোড়ন ফেলতে পারব? এমন বড় বড় স্বপ্ন বুকে লালন করে পা রাখলাম কলেজে।
কলেজে উঠে এবার ইংরেজি ছবি দেখা শুরু করলাম। স্কুলে পড়ালেখা তেমন শিখিনি, তবে হ্যাঁ, ড্রয়িং ক্লাসে আঁকা শিখেছিলাম। রং করা শিখেছিলাম। এই শিক্ষাটাকে সম্বল করে আঁকাআঁকি চালিয়ে গেলাম। এর মধ্যে কলেজে একদিন এক বন্ধু মডেলিং করার প্রস্তাব দিল। বললাম, ‘বলিস কী! আমি পারব?’ সে বলল, ‘অবশ্যই।’ শুরু করলাম মডেলিং। ১৯ বছর বয়সে বাবাকে বললাম, ‘আমি পৃথিবীটা দেখতে চাই।’ বাবা বললেন, ‘তুমি তো মডেলিং করছ। টাকা জমাও, তারপর যেখানে খুশি যাও।’ এরপর মডেলিংটা পুরোদমে করা শুরু করলাম। যত কাজ পেতাম, সব লুফে নিতাম। সেই আমলে শুধু মডেলিং করে আমি ৯০ হাজার রুপি জমিয়েছিলাম। জীবনে প্রথম গেলাম সিঙ্গাপুরে, তারপর ব্যাংককে। নিজের টাকায় বিদেশে যাচ্ছি ভেবে কী যে গর্ব হচ্ছিল! ফিরে এসে এতটাই রোমাঞ্চিত ছিলাম যে ঠিক করে ফেলেছিলাম আমি এয়ার ইন্ডিয়ায় চাকরি করব। ওদিকে কলেজের সাধারণ জ্ঞান পরীক্ষায় নিয়মিতই ফেল করছিলাম, কারণ আমার জ্ঞানের জগতে সিনেমা ছাড়া কিছুই ছিল না।
এরপর একটা বুটিকের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ নিলাম। আমার মা-বাবা রীতিমতো আঁতকে উঠলেন। বললেন, ‘করছ কী? বিক্রয়কর্মী হিসেবে শুরু করেছ, শেষ পর্যন্ত তুমি কি দরজি হবে? এর চেয়ে বরং বাবার এয়ার কন্ডিশনের ব্যবসায় যোগ দাও।’ আমার বক্তব্য ছিল, ‘না, আমি হব সিনেমার পরিচালক।’ মা বললেন, ‘পরিচালক! নায়ক নয় কেন?’ পাঞ্জাবের সব মা-ই ভাবেন, তাঁর ছেলে দেখতে নায়কের মতো। এবং তাঁরা ধরেই নেন, চলচ্চিত্রে নায়ক হওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।
বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করার সময় আমি দরজির পাশেই বসতাম। খুব কৌতূহল নিয়ে তাঁর কাজ দেখতাম। প্রশ্ন করতাম। ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথা বলতাম। আর সারা দিন আঁকতাম। ম্যানিকুইনগুলোকে জামা পরাতাম। বলছি ১৯৮৮ সালের কথা, তখন ভারত ফ্যাশনের দুনিয়ায় মাত্রই নাম করতে শুরু করেছে।
পরিচালক হওয়ার ভূত তখনো মাথা থেকে নামেনি। ইচ্ছা ছিল ইয়াশ চোপড়ার সহকারী হব। একদিন বাড়িতে বললাম, ‘আমি ডিজাইনার হতে চাই।’ শুনে মা আঁতকে উঠলেন। ‘ডিজাইনার! মানে দরজি!’ আমি বললাম, ‘না, ডিজাইনার মানে দরজি নয়।’ বাড়িতে দুটি সেলাই মেশিন ছিল। আমি সালোয়ার-কামিজ বানানোর অর্ডার নিতে শুরু করলাম। এবার মায়ের মাথায় রীতিমতো বাজ পড়ল, ‘আমার ছেলে বাড়িতে বসে সালোয়ার-কামিজ বানায়, এ কথা পাড়া-প্রতিবেশীকে বলব কী করে!’
এমন সময় এক আলোকচিত্রীর সঙ্গে পরিচয় হলো, সে আমাকে শ্রীদেবীর সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে গেল। শ্রীদেবী তখন বিরাট তারকা। ১৯৯০ সাল। স্বর্গ ছবিতে জুহি চাওলার একটা গানে কাজ করার সুযোগ পেলাম। তখন চলচ্চিত্রজগতে তেমন কোনো ডিজাইনার ছিলেন না। সিনেমা আর ফ্যাশন, দুটোর মানই খানিকটা নিম্নমুখী। ভাবলাম এটাই সুযোগ। আমি যদি এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারি, তাহলে হয়তো নাম করতে পারব। বিদেশে গিয়ে ফ্যাশন নিয়ে পরার মতো আর্থিক অবস্থা ছিল না। দিল্লিতে গিয়ে যে পড়ব, সেটাও আমি চাইনি। কারণ, সেখানে গিয়ে কোনো আত্মীয়স্বজনের ঘাড়ে ভর করার ইচ্ছা ছিল না। ভাবলাম যা হয় হোক, কাজ শুরু করি। বয়স তখন ২৩। মডেলিং পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে আমি নায়ক-নায়িকাদের পোশাকের ডিজাইন করা শুরু করলাম। খুব দ্রুত আঁকতে পারতাম, তাই প্রথম দু-তিন বছর প্রচুর কাজ পেয়েছি। বাবা বলতেন, ‘করছ কী! এসব করতে গিয়ে মডেলিং ক্যারিয়ারটাও হারাবে।’
কিন্তু আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। আর যা-ই হোক, বাবার এয়ার কন্ডিশনের ব্যবসা আমি করব না। আমিই প্রথম ভারতীয় ছবিতে চরিত্র অনুযায়ী নকশা করা শুরু করলাম। পোশাকের নকশা করার আগে জানতে চাইতাম, ‘চরিত্রের মেকআপ কেমন হবে? চুলের স্টাইল কেমন?’ অভিনয়শিল্পীরা বলত, ‘কস্টিউম ডিজাইনার কেন মেকআপের কাজে নাক গলাচ্ছে? তাঁর কাজ তো জামা বানানো!’ মনে আছে, রাভিনা ট্যান্ডনের সঙ্গে একটা ছবিতে একবার পরিচালক বললেন, ‘আমি কিছু ওয়েস্টার্ন পোশাক চাই। নায়িকাকে যেন আবেদনময়ী দেখায়।’ আমি বললাম, ‘সিনেমার গল্পটা কী? নায়িকার চরিত্রটা কেমন?’ পরিচালক কড়া দৃষ্টিতে তাকালেন। ভাবখানা এমন, ব্যাটা কস্টিউম ডিজাইনারের কত বড় সাহস, সে ছবির গল্প জানতে চায়!
সেই সময়ের ‘ছোট’ পরিচালক আদিত্য চোপড়া, করন জোহর, রাম গোপাল ভার্মার সঙ্গে কাজ শুরু করলাম। রঙ্গিলা আর রাজা হিন্দুস্তানি ছবিতে কাজ করলাম। ১৯৯৫ সালে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন ‘কস্টিউম ডিজাইনার’কে পুরস্কৃত করা হলো, সেই মানুষটা আমি। যেই আমার একটা সময় পর্যন্ত দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি, সেই আমি প্রতি সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডে যেতে শুরু করলাম। যদি নব্বইয়ের দশকে জন্মে থাকো, তুষারপাতের মধ্যে নায়িকার শিফন শাড়ি ওড়ার দৃশ্য নিশ্চয়ই দেখেছ। যে দৃশ্যে নায়ক মাফলার-কোট পরে দাঁড়িয়ে থাকে আর নায়িকা আঁটসাঁট ব্লাউজ পরে, সেখানে তাঁর শাড়ি সামলানোর দায়িত্ব আমাকেই নিতে হয়।
আমি সুইজারল্যান্ড, লন্ডন, নিউইয়র্কে গেছি। দোকানে দোকানে ঘুরেছি। বেড়ানো, মানুষ আর ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি দেখা—এটাই আমার শিক্ষা। দেখে দেখে শিখেছি। চলচ্চিত্রে কাজ করার স্বপ্ন ছিল। আজ দেশসেরা প্রযোজক, অভিনয়শিল্পী, পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করছি। আমি ভারতের প্রথম ফ্যাশন ডিজাইনার, যে ৯ হাজার ৫০০ বর্গফুটের একটা পোশাকের দোকান চালু করেছিল। একটা পোশাক নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের দাম হবে ১০০ কোটি রুপি, ভারতে তখন কেউ ভাবতেও পারত না।
শাবানা আজমির সঙ্গে আমি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা চালাই। আমাদের প্রতিষ্ঠানে ২৮০ জন নারী কাজ করেন। মিজবান নামের একটা গ্রামে বসে তাঁরা চমৎকার চিকানকারি (একধরনের ভারতীয় কাপড়) তৈরি করেন। আন্তর্জাতিক বাজারে আমি বেনারস, মিজবানের কাপড় পৌঁছে দিতে চাই। ভারতীয় ডিজাইনার আর কাপড় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা নিশ্চয়ই এই অর্জন উদ্যাপন করতে পারি।

অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ, সূত্র: ভোগ