যে মুগ্ধতার আবেশ কাটে না

ড. মাহবুবুল হক
ড. মাহবুবুল হক

ট্রেনটা চলছে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার পথে। এখনকার এসি ট্রেন না, সেই নব্বইয়ে কু ঝিক ঝিক করে হেলেদুলে চলা ট্রেন। সিটে বসে আবিষ্ট মনে একজন লিখে চলছেন। অন্য যাত্রীরা তাঁকে কৌতূহলী চোখে দেখছেন। হাত থেকে কলমটা বা কাগজটা পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেউ না কেউ আগ বাড়িয়ে তুলে দিচ্ছেন। কেউই তাঁকে চেনেন না। কিন্তু এই মানুষটি যে অত্যন্ত বিদ্বান, সেটি বুঝতে কারোরই অসুবিধা হচ্ছে না। একটি ছোট মেয়েও মানুষটিকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। অনুসরণ করছে আশপাশের মানুষের শ্রদ্ধামিশানো দৃষ্টিকে। তার বুক গর্বে ভরে যাচ্ছে। কেননা এই মানুষটা তার জন্মদাতা পিতার পরিচয় ছাপিয়ে অনেক ওপরের আসনে আসীন হয়ে আছেন। তার কাছে মানুষটি শুধু চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান, বাংলা সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বের অন্যতম লেখক-গবেষক নন, তিনি সমগ্র বাংলাদেশের গর্ব। তিনি ড. মাহবুবুল হক।

ঠিক ৭০ বছর আগে আজকের দিনে ফরিদপুরের মধুখালীতে মানুষটি জন্মেছিলেন। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা ৪০টির বেশি। ফিলিপস পুরস্কার, মধুসূদন পদক, নজরুল সম্মাননা পদক, মুক্তিযুদ্ধ পদক, চট্টগ্রাম একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য অর্জন তাঁর সাফল্যের ঝুড়ি আছে। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত দুই বাংলার প্রথম সমন্বিত ব্যাকরণ ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ গ্রন্থের তিনি সহযোগী সম্পাদক ও লেখক। স্কুল ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা পাঠ্যক্রম প্রণয়নকারীদের অন্যতম তিনি। কিন্তু তাঁর সব সাফল্যকে ছাড়িয়ে মুগ্ধ ভক্ত সেই বালিকাটিকে আকর্ষণ করত তার বাবার প্রগতিশীল আধুনিক চিন্তাভাবনা, অপরিসীম দেশপ্রেম, ছাত্রদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, ছোট-বড়-ধনী-দরিদ্র সবার প্রতি বিনয়ী ব্যবহার।

বাবার বইয়ের সংগ্রহও মেয়েটিকে অভিভূত করত। ছোট্ট বাসার প্রতিটি দেয়াল ছাড়িয়ে অসংখ্য রং এবং আকারের হাজারো বইয়ের ঠাঁই হয়েছিল রান্নাঘরের কোণেও। বইকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, তা মেয়েটি শিখেছিল বাবার কাছ থেকেই। বইয়ের পাতা ভাঁজ করা যাবে না, যতটুকু পড়া হয়েছে সেই পাতার নম্বর মনে রাখতে হবে। মুড়িয়ে পড়া যাবে না, তাতে বইয়ের বাঁধাই নষ্ট হবে। দাগানো যাবে না, প্রয়োজনে আলাদা খাতায় নোট নিতে হবে। যে ব্যক্তি একটা বইয়ের প্রতি এতটা সংবেদনশীল, মানুষের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও মমতা কতটুকু, তা তো বলাই বাহুল্য।

সারা বছর আমাদের বাসাজুড়ে চলত ছাত্রদের অবাধ বিচরণ। বাসায় ‘স্যার’ থাকুক আর নাই থাকুক, ছাত্ররা যখন ইচ্ছা আসবে, যখন ইচ্ছা যাবে, যত ইচ্ছা বই পড়বে, কোনো বাধা নেই। বরং ধোঁয়া তোলা এক কাপ চা ঠিকই সামনে পৌঁছে যাবে।

মেয়েটি অবাক হয়ে দেখত গবেষণা ও শিক্ষকতার বিশাল দায়িত্ব বাদেও তার বাবা আরও কত কিছু নিয়ে ব্যস্ত! ছাত্রাবস্থায় বিতর্ক, অভিনয়, গল্প-কবিতা লেখা, লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশসহ অসংখ্য কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। আরও ছিলেন দক্ষ সংগঠক। তাই বাসায় ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যসহ অনেক মানুষ আসা-যাওয়া চলত। সবাই তাঁদের কাজের সঙ্গে মাহবুবুল হককে চাইতেন। আর তিনিও সবার জন্য নিবেদিত প্রাণ।

বাবার আরেকটি পরিচয় বেশির ভাগ মানুষই জানে না। তরুণ মাহবুবুল হক বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের তুখোড় নেতা ছিলেন। মেয়েটি সব সময় গর্ববোধ করে যে, তার বাবা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। দাদির মুখে শোনা যুদ্ধকালীন একটা গল্প তার খুব ভালো লাগে। পাকিস্তানি সেনারা বাবাকে গ্রেপ্তার করবে বলে এলাকায় এসেছে। তারা বিভিন্ন মানুষের কাছে জানতে চাচ্ছে, ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হকের বাসা কোনটা। কিন্তু কেউ তা বলতে পারছে না। কেননা এলাকার মানুষ মেধাবী ছাত্র ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মাহবুবকে চেনেন। কিন্তু রাজনীতি করা মাহবুবকে চেনেন না। মাহবুবকে খুঁজে না পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা চলে যায়। কিছুদিন পর তারা আবার আসে। এবার তারা জানতে চাইল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র মাহবুবুল হকের বাড়ি কোনটি। সঙ্গে সঙ্গে ঠিকানা পেয়ে গেল। তত দিনে অবশ্য মেয়েটির বাবা দেশমাতৃকার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চলে গেছেন।

এ রকম ব্যস্ত মানুষেরা সন্তানদের একটু কম সময় দেবেন, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তা নিয়ে মেয়েটির কোনো দুঃখবোধ ছিল না। কেননা, প্রথমত এমনিতেই বাবার সব কাজকর্মই তার ভালো লাগত। অন্যদিকে উদার মানসিকতার বাবা তাকে দিয়েছিলেন এমন এক অসামান্য উপহার, যা আমাদের সমাজে খুব কম মেয়েই পায়। তার নাম—স্বাধীনতা। নিজের জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মেয়েটি নিজেই নিয়েছে। তার চলার পথের কোনো বাঁকেই বাবা বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বরং প্রতি মুহূর্তে তার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন।

বাড়ি ছেড়ে বহু দূরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও মেয়েটি অসংখ্যবার তার বাবার চিন্তার উদারতা উপলব্ধি করে অবাক হয়েছে।

সেই মেয়েটি এখন অনেক বড়। তাঁর নিজেরই একটা পাঁচ বছর বয়সী কন্যা আছে। সেই শিশুটিও নানার একান্ত অনুসারী। তিনি ছবি আঁকেন। মজার মজার খেলা শেখান। মুখে মুখে কবিতা বানান। মুগ্ধতা সম্ভবত এভাবেই সঞ্চারিত হয় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। সেই মুগ্ধতা ছাড়িয়েছে পরিবারের গণ্ডিকেও। হুট করে রাস্তায় যখন কোনো অল্পবয়স্ক তরুণ মেয়েটির কাছে জানতে চায়, সে ড. মাহবুবুল হকের কন্যা কি না, আর বলে—প্রথম আলোর কোনো এক ভাষা প্রতিযোগে বিচারক হিসেবে উপস্থিত মাহবুব স্যার তাকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ চেয়ে সে তাঁর কাছে চিঠি লিখত, মেয়েটি তখন মোটেই অবাক হন না। তিনি হেসে মাথা নাড়েন। বাবার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সে যে প্রদীপের নিচের অন্ধকার, প্রদীপের আলো সবাই যদি পায়, যদি তারা মুগ্ধ হয়, সেটাই অন্ধকারের সবচেয়ে বড় সুখ।

শুভ জন্মদিন আব্বু।

উপমা মাহবুব: ড. মাহবুবুল হকের কন্যা এবং ব্যবস্থাপক গ্লোবাল অ্যাডভোকেসি, ব্র্যাক