জন্মদিন বলে যে একটা ব্যাপার আছে আমার জানা ছিল না

>কাল কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। নানা অঙ্গনে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে স্মরণ করা হচ্ছে এই প্রয়াত লেখককে। ছেলেবেলায় কীভাবে পালন করা হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন; ‘পদ্ম পাতায় জল’ শিরোনামে সে কথা তিনি লিখেছেন কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আমার ছেলেবেলা বইতে। আজ সেই বইয়ের একটি অংশ প্রকাশিত হলো
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ


আমাদের পাশের বাসায় থাকত নাদু দিলুরা। তারাও আমাদের মতোই অল্প আয়ের বাবা-মা’র পুত্র-কন্যা। সবাই একসঙ্গে ধুলোমাটিতে গড়াগড়ি করে বড় হচ্ছি। ওমা! একদিন শুনি ওরা বড়লোক হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে ওদের কাপড়চোপড় পাল্টে গেল। কথাবার্তার ধরন-ধারণও বদলে গেল। এখন আর ওরা দাঁড়িয়াবান্দা কিংবা ছি-বুড়ি খেলার জন্যে আমাদের কাছে আসে না।

ঈদ উপলক্ষে ওরা নতুন কাপড় তো পেলই, সেই সঙ্গে ট্রাই সাইকেল। ট্রাই সাইকেলটি শিশুমহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি করল। আমিও এর আগে এই জিনিস দেখিনি। কী চমৎকার ছোট্ট একটা রিকশা। এর মধ্যে আবার বেলও আছে। টুং টুং করে বাজে। এই বিস্ময়কর বাহনটিতে একবার শুধু চড়তে পারার দুর্লভ সৌভাগ্যের জন্যে আমি তখন আমার সমস্ত পৃথিবী দিয়ে দিতে পারি। চেষ্টা করে বিফল হলাম। সব সময় নাদু দিলুর সঙ্গে একজন কাজের মেয়ে থাকে। আমি কাছে গেলেই সে খ্যাঁক করে ওঠে। হাত দিয়ে একটু দেখার অনুমতি চাইলাম, সেই অনুমতিও পাওয়া গেল না। আমরা শিশুরা সমস্ত কাজ-কর্ম ভুলে ট্রাই সাইকেল ঘিরে গোল হয়ে বসে রইলাম। অনেক চিন্তা করে দেখলাম ট্রাই সাইকেল কেনার কথা বাবাকে কি বলা যায়? মনে হলো সেটা ঠিক হবে না। বাবার তখন চরম আর্থিক সমস্যা যাচ্ছে। তাঁর সবচেয়ে আদরের ছোট বোন অসুস্থ। সেই বোনের চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার তাঁর বহন করতে হচ্ছে। ঈদে আমরা ভাই-বোনেরা কোনো কাপড়চোপড় পাইনি। শেষ মুহূর্তে বাবা আমাদের তিন ভাইবোনকে তিনটা প্লাস্টিকের চশমা কিনে দিলেন, যা চোখে দিলে আশপাশের জগৎ নীল বর্ণ ধারণ করে। কাপড় না পাওয়ার দুঃখ রঙিন চশমায় ভুললাম। তার চেয়েও বড় কথা, দিলু এই চশমার বিনিময়ে আমাকে তার ট্রাই সাইকেল খানিকটা স্পর্শ করার দুর্লভ সুযোগ দিল। সে বড়ই আনন্দময় অভিজ্ঞতা।

যতই দিন যেতে লাগল, এদের রমরমা সমসমা বাড়তেই লাগল। শুনলাম তাদের জন্যে বিশাল দোতলা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। বাড়ি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কোনো রকম কষ্টে-সৃষ্টে এখানেই থাকবে। এর মধ্যে এ দুই ভাইবোনের জন্মদিন হলো। জন্মদিন বলে যে একটা ব্যাপার আছে আমার জানা ছিল না। এই দিনে উৎসব হয়। খানাদানা হয়। উপহার নিয়ে লোকজন আসে কে জানত। আমরা অভিভূত।
শেফু একদিন বাবাকে গিয়ে বলল, আমার জন্মদিন করতে হবে।
বাবা খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছে মা, করা হবে। কিন্তু শুধুই একবার। এই উৎসব আমি দ্বিতীয়বার করব না। তোমরা বড় হওয়ার চেষ্টা করো। অনেক বড়, যাতে সারা দেশের মানুষ তোমাদের জন্মদিনের উৎসব করে। বাবা-মা’র করতে না হয়।
শেফু বলল, সে প্রাণপণ চেষ্টা করবে বড় হওয়ার।

আমি দেখলাম সুযোগ ফসকে যাচ্ছে। শুধু শেফুর জন্মদিন হবে আমার হবে না, এ কেমন কথা! আমি গম্ভীর গলায় বললাম, বাবা আমিও খুব বড় হওয়ার চেষ্টা করব। আমারও জন্মদিন করতে হবে। বাবা বললেন, আচ্ছা তোমারও হবে।
শুধু ইকবাল ঘোষণা করল সে বড় হতে চায় না। ছোটই থাকতে চায়। তার জন্মদিন লাগবে না।
আমরা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। নভেম্বরের ৯ তারিখ শেফুর জন্মদিন। দেখতে দেখতে ৯ তারিখ এসে পড়ল। আমরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে লক্ষ করলাম এ উপলক্ষে কাউকে বলা হলো না। বাবা বললেন, আমরা নিজেরা নিজেরা উৎসব করব। কাউকে বলব না।

পায়েস ছাড়া অন্য কোনো খাদ্যদ্রব্য তৈরি হলো না। আমাদের মন ভেঙে গেল। সন্ধ্যার পর জন্মদিনের উৎসব শুরু হলো। বাবা ‘বীর পুরুষ’ কবিতা আবৃত্তি করলেন। প্রাণেশ কাকু তিনটা গান গাইলেন। পায়েস খাওয়া হলো। তারপর বাবা ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিয়ে শেফুর হাতে একটা উপহারের প্যাকেট তুলে দিলেন। সেই উপহার দেখে আমাদের সবার বিস্ময়ে বাকরোধ হয়ে গেল। আমার দরিদ্র বাবা খুবই দামি উপহার কিনেছেন। চীনেমাটির চমৎকার খেলনা ‘টি সেট’, যা দেখলে একালের শিশুদেরও চোখ কপালে উঠে যাওয়ার কথা।
বাবা বললেন, পছন্দ হয়েছে মা?

শেফু কাঁদতে কাঁদতে বলল, এত সুন্দর জিনিস সে তার জীবনে দেখেনি। আনন্দে সারা রাত সে ঘুমাতে পারল না। বারবার বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দেখে আসে টি সেট ঠিকঠাক আছে কি না। সেই রাতে আমি নিজেও উদ্বেগে ঘুমুতে পারলাম না। আর মাত্র তিন দিন পর আমার জন্মদিন। না জানি কী অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। গোপন সূত্রে খবর পেলাম, আমার জন্যে দশ গুণ ভালো উপহার অপেক্ষা করছে। খবর দিলেন মা। মা’র খবর খুবই নির্ভরযোগ্য।
জন্মদিন এসে গেল। গান, কবিতা আবৃত্তির পালা শেষ হওয়ার পর আমার হাতে উপহারের প্যাকেট তুলে দেওয়া হলো। প্যাকেট খুলে দেখি একটা বাঁধানো ফ্রেমে দীর্ঘ একটি কবিতা। বাবা ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে একটি কবিতা লিখে ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিয়ে এসেছেন। কবিতার প্রথম দুটি চরণ—

সাতটি বছর গেল পরপর আজিকে পড়েছো আটে
তব জন্মদিন নয়তো মলিন ভয়াল বিশ্ব হাটে...
বাবা খুবই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, উপহার পছন্দ হয়েছে? অনেক কষ্টে কান্না চাপা দিয়ে বললাম—হ্যাঁ।
তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে পছন্দ হয় নাই।
আমি চুপ করে রইলাম।
বাবা খানিকক্ষণ শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, এই উপহার এখন তোর কাছে সামান্য মনে হচ্ছে। এমন একদিন আসবে, যখন আর সামান্য মনে হবে না।
বাবা কবি ছিলেন না। হৃদয়ের তীব্র আবেগ আকাশের মাধ্যম হিসেবে তিনি কবিতার আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর অতি আদরের ছোট বোনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তিনি কাঁদতে কাঁদতে কবিতা লিখতে বসেছেন। চোখের জলে লেখা সেই দীর্ঘ কবিতা হয়তো শুদ্ধতম কবিতা হয়নি। কিন্তু যে আবেগের তাড়নায় কলম হাতে নিয়েছিলেন, সেই আবেগে কোনো খাদ ছিল না। বাবার কাছ থেকে প্রথম শিখলাম মনে তীব্র ব্যথা কমানোর একটি উপায় হচ্ছে কিছু লেখা। যে লেখা ব্যক্তিগত দুঃখকে ছড়িয়ে দেয় চারদিকে। (সংক্ষেপিত)