গণপরিবহনে নারীদের নানা দুর্ভোগ

গণপরিবহনে যুদ্ধ করেই উঠতে হয় নারীদের l ছবি: প্রথম আলো
গণপরিবহনে যুদ্ধ করেই উঠতে হয় নারীদের l ছবি: প্রথম আলো

এমনটা শুধু কবিতার ক্ষেত্রে নয়, রাজধানীতে গণপরিবহনে চলাচল করেন এমন নারী যাত্রীদের কম-বেশি এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ইয়াসমিন রহমান মতিঝিলের একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। থাকেন পল্লবীতে। রোজ তাঁকে কমপক্ষে চার ঘণ্টা যানজট পেরিয়ে যাওয়া-আসা করতে হয়। ইয়াসমিন রহমান বলেন, ‘এ ভোগান্তির সঙ্গে সঙ্গে সব সময় চোখ-কান খোলা রাখতে হয়। একটু অসতর্ক হলেই নানাভাবে নিপীড়িত হতে হয়।’ নতুন ভোগান্তি হিসেবে যুক্ত হয়েছে চালক এবং সহকারীর ধূমপান। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য গণপরিবহনে বিশেষ ব্যবস্থা রাখার দাবিও অনেক নারীর।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গণপরিবহনে নারীদের পরিধেয় বস্ত্র কেটে দেওয়ার বেশ কিছু পোস্ট চোখে পড়ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, তাঁদের কাছেও এ বিষয়ে কিছু অভিযোগ এসেছে।

গণপরিবহনে নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৯টি আসন রয়েছে। ১০টি বাস ঘুরে দেখা গেছে, কোনো কোনো বাসে ৪টি বা ৫টি আসন নারীদের জন্য রাখা হয়েছে। কোনো বাসে আবার সেই আসনে পুরুষ বসে আছেন। নারী যাত্রী উঠলে তাঁদের সিট ছেড়ে দিতে বললেও ঝামেলার সৃষ্টি হয়।

নারীদের জন্য নির্ধারিত আসনে পুরুষ যাত্রী বসলে বা বসতে দিলে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধান যুক্ত করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৭-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিল মন্ত্রিসভা। জানা গেছে, আইন কমিশন থেকে বিধানটি নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, নারী-শিশু-অসুস্থ ও বয়স্ক মানুষদের জন্য বাসে অবশ্যই পৃথক ব্যবস্থা রেখে আইনটি পাস করা উচিত।

রাজধানীতে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী নারীদের জন্য বাসের সংখ্যা বাড়ছে না। কর্মজীবী নারীদের জন্য রাজধানীর ৮টি রুটে শুক্র ও শনিবার ছাড়া প্রতিদিন বিআরটিসির ১৫টি বাস চলাচল করে। একটি বাদে সব কটির গন্তব্যই মতিঝিল। বাসগুলো সকাল ৭টার দিকে ছাড়ে, ফেরে বিকেল ৫টার দিকে।

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ‘নারী সংবেদনশীল নগর-পরিকল্পনা’ শীর্ষক একটি জরিপের তথ্য বলছে, গণপরিবহনে চলাচলকারী ৮৬ শতাংশ নারী যানজট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। পরিবহনব্যবস্থা ভালো না থাকায় ৫৬ শতাংশ নারী বাইরে যেতে চান না বলে জানান। আবার, ২৩ শতাংশ নারী বলেছেন, বাসের চালক বা সহকারীরা তাঁদের সঙ্গে অপমানজনক আচরণ করেছেন। ২০১৬ সালে নগরের বিভিন্ন বয়সী ও পেশার ২০০ জন নারীর মধ্যে জরিপটি চালানো হয়।

এ বিষয়ে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, ‘সমাজে নারীরা প্রতিনিয়ত অসম্মানজনক আচরণের শিকার হচ্ছেন, এর বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ নেই। সহিংসতা, যৌন নিপীড়নের ক্ষেত্রেও তা-ই। এর বড় কারণ, আইন আছে তবে তার বাস্তবায়ন নেই। এমনকি জবাবদিহির সংস্কৃতিও অনুপস্থিত। তবে নারীরাও অনেক সময় অপরাধ সহ্য করেন, যা ঠিক নয়। এতে অপরাধীরা প্রশ্রয় পায়।’

এ সপ্তাহের প্রথম দুদিনে রাজধানীতে গণপরিবহনে চলাচল করে এমন বেশ কিছু নারীর সঙ্গে  কথা হয়। তাঁরা বলেন, রোজ যুদ্ধ করে বাসে চলাচল করতে হয়। সন্ধ্যায় তো তাঁদের বাসে তুলতেই চায় না। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অনেক সময় চালকের সহকারীরা টেনেহিঁচড়ে তোলেন। তারপরও নারীদের আসনগুলো থাকে ইঞ্জিনের পাশে। এখন আবার চালক বা তাঁর সহকারীরা বাসে বসেই ধূমপান করেন। কোনো নারী প্রতিবাদ করলে তাঁকে বাস থেকে নেমে যেতে বলা হয়। এমনকি গাড়িতে বসে এখন তাঁদের মাদক নিতেও দেখা যায়।

এ বিষয়ে একটি বাসের চালক মো. জসিমউদ্দিন বলেন, ‘মিরপুরের দুয়ারীপাড়ার থিকা গাড়ি ছাইড়্যা সদরঘাট যাইতে দুই থিকা তিন ঘণ্টা লাগে। এতক্ষণ কি সিগারেট না খাইয়া থাকন যায়।’

সম্প্রতি মিরপুর ১০ নম্বরে এক নারী যাত্রী বাসের সহকারীকে গাঁজা বানাতে দেখেন। এ নিয়ে তিনি প্রশ্ন করলে চালক ও সহকারী তাঁকে উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘আপনি ছাত্রী হইয়া গাঁজা চেনেন ক্যামনে?’ এ সময় বাসের পুরুষ সহযাত্রীরা চুপ ছিলেন বলে এই শিক্ষার্থী জানান।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি ঢাকা শহরে বাসচালক ও তাঁদের সহযোগীদের নিয়ে একটি জরিপ চালাচ্ছে। তাতে দেখা যায়, ৮৬ শতাংশ চালক এবং তাঁর সহযোগী মাদকের সঙ্গে জড়িত। জরিপটিতে ১ হাজার ৩০টি বাসের চালক ও এর সহকারীদের পর্যবেক্ষণ করা হয়।