সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বন্ধু

সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলছেন নাবেল আল মাসরি। ছবি: সংগৃহীত
সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলছেন নাবেল আল মাসরি। ছবি: সংগৃহীত
সিঙ্গাপুর পুলিশের স্পেশাল কনস্টেবল করপোরাল (সিপিএল) বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাবেল আল মাসরি। এই তরুণ প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করতে সাহায্য করেছেন। সেই কৃতিত্বের কথা মলাটবন্দী হয়েছে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল সার্ভিস প্রকাশিত একটি বইয়ে। প্রতিবেদন হয়েছে সিঙ্গাপুরের দ্য স্ট্রেইটস টাইমস পত্রিকায়। বাংলাদেশে বেড়াতে এসে শোনালেন আরও অনেক কথা। নাবেল আল মাসরির অভিজ্ঞতা থাকছে ছুটির দিনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে।


প্রথমেই বললেন, ‘আমি একটু ইনট্রোভার্ট (অন্তর্মুখী)।’ এমন একটা বাক্য দিয়েই নাবেল আল মাসরির সঙ্গে আলাপের শুরু। তবে সংশয় কেটে গেল খানিক পরেই। বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা আর ব্যক্তিজীবনের নানা কথা যেভাবে এগোল, এরপর এই তরুণকে আর যা–ই বলা হোক, অন্তর্মুখী বলা যায় না।

আলাপে ঢোকার আগে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই তরুণের কথা একটু বলে নেওয়া যাক। নাবেল আল মাসরি সিঙ্গাপুর পুলিশ ফোর্সের (এসপিএফ) স্পেশাল কনস্টেবল করপোরাল (সিপিএল)। অস্থায়ী এ পেশায় তিনি জড়িয়েছেন গত বছরের এপ্রিলে। তবে বছর দেড়েকের মধ্যেই একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন তিনি। কেমন সেটা?

যানজট ঠেলে উত্তরা থেকে কারওয়ান বাজারে আসার ধকল ততক্ষণে সামলে নিয়েছেন। প্রশ্ন শুনে একহারা গড়নের নাবেল চোখ থেকে কালো রোদচশমা খুলে হাতে নিলেন। বললেন, ‘আমি সিঙ্গাপুরের ওল্ডল্যান্ড ইস্ট এলাকায় দায়িত্ব পালন করি। সেখানে বাংলাদেশি নির্মাণ ও জাহাজশ্রমিকদের বসবাসের অনেক ডরমিটরি রয়েছে। আমি ডরমিটরিগুলোতে যাই, আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কে সচেতন করি।’ এক সপ্তাহের জন্য ঢাকায় এসেছেন। ১২ নভেম্বর প্রথম আলো কার্যালয়ে বসেই কথা হলো।

নাবেল আল মাসরি ছবি: আবদুস সালাম
নাবেল আল মাসরি ছবি: আবদুস সালাম

নাবেল বলতে শুরু করেন, ‘প্রবাসী শ্রমিকদের ভাষাগত কারণে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যা হতো। অনেকে হয়রানির মধ্যে পড়তেন, সমস্যার কথাও বুঝিয়ে বলতে পারতেন না।’

নাবেলের মতো বাংলাভাষী একজন পুলিশ কর্মকর্তা পেয়ে শ্রমিকেরা নিজেদের বিভিন্ন সমস্যার কথা খুলে বলার সুযোগ পেলেন, জানতে পারলেন প্রশাসনের নিয়মকানুনও। এখন নাকি ওল্ডল্যান্ড এলাকায় টহলে বের হলেই বাংলাদেশি শ্রমিকেরা এগিয়ে আসেন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। নিজেদের নানা সমস্যার কথা অনায়াসে বলেন। বাংলা বলার সুবিধা প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছে।

তথ্যচিত্রের জন্য সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন নাবেল। ছবি: সংগৃহীত
তথ্যচিত্রের জন্য সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন নাবেল। ছবি: সংগৃহীত

তবে ‘জনপ্রিয়’ শব্দটা শুনে নাবেল ইতস্তত করতে থাকেন। ‘আমার জায়গায় অন্য কোনো বাঙালি থাকলে হয়তো এমনটাই করতেন। এনএসে (ন্যাশনাল সার্ভিস) আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন বাংলাদেশি পরিবারের ছেলে ঢুকেছে, তারা অন্য দায়িত্ব পেয়েছে। আমি কমিউনিটি এনগেজমেন্টের দায়িত্ব পেয়েছি, এটা আমার ভাগ্য বলা যায়।’ বলেন নাবেল।

পুলিশ বিভাগে নাবেল কাজ করছেন নাগরিক কর্তব্য হিসেবে। সিঙ্গাপুরের প্রত্যেক পুরুষ নাগরিককে বাধ্যতামূলকভাবে দুই বছর সরকারি সংস্থায় চাকরি করতে হয়। এটাকে বলে ন্যাশনাল সার্ভিস (এনএস)। এই চাকরিটা করতে হয় ‘ইউনিফর্মড সার্ভিস’ বা দেশটির আর্মড ফোর্স, সিঙ্গাপুর পুলিশ ফোর্স, সিঙ্গাপুর সিভিল ডিফেন্স ফোর্সের মতো সংস্থার হয়ে। শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ প্রস্তাব করে তিনি কোন চাকরির যোগ্য।

নাবেলের সেতুবন্ধ

ডরমিটরিগুলোতে হাজারখানেক শ্রমিক থাকেন। নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন অনেকে। চুরি ও মাদক ব্যবসার দায়েও অভিযুক্ত হন শ্রমিকেরা। নাবেলের দায়িত্ব বিভিন্ন ডরমিটরিতে গিয়ে অপরাধমূলক এসব কাজের শাস্তি সম্পর্কে জানানো। মতবিনিময়ের এই কাজটি নাবেল করেন ‘ক্রাইম প্রিভেনশন টক’ নামে। এই আয়োজনের মাধ্যমে ডরমিটরির সব শ্রমিককে ডাকা হয়। প্রচারপত্র ও হ্যান্ডমাইকে সচেতন করা হয়। সেই সঙ্গে জানানো হয় জঙ্গিবাদ, ফটকাবাজদের কাছে প্রতারিত না হওয়ার উপায় সম্পর্কেও।

এসব তো আছেই। নাবেল প্রশংসিত হয়েছেন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য। নাবেল বলেন, ‘ডরমিটরিতে মাদকের ব্যবসা করার জন্য তিনজন বাংলাদেশি শ্রমিক অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁদের বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু দেশে ফেরার জন্য বিমানবন্দরে এসে হাওয়া হয়ে যান।’

লাপাত্তা হওয়া এই তিন মাদক ব্যবসায়ীকে ধরতেই গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে কাজ করেন নাবেল। পালিয়ে গিয়েও মাদকের ব্যবসা চালাতে থাকেন আগের মতো। পুলিশ কোনোভাবেই কূলকিনারা করতে পারছিল না। তবে জানতে পারে, তিনজন তাঁদের এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। সেই বন্ধুকে ধরা হয়। কিন্তু তাঁর ভাষাজ্ঞানের কারণে বিপত্তিতে পড়ে গোয়েন্দা পুলিশ। তখনই ডাক পড়ে নাবেল আল মাসরির। তিনি বলেন, ‘আমি ভদ্রলোককে বোঝাই। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ঠিকানা জানতে চাই। কিন্তু তিনি স্বীকার করেন না। একসময় তাঁকে অভয় দিই। ধীরে ধীরে তিনি সব বলে দেন।’ ধরা পড়েন তিন মাদক ব্যবসায়ী।

স্মরণিকায় নাবেল–বন্দনা
স্মরণিকায় নাবেল–বন্দনা

সেবার বইয়ে নাবেল–বন্দনা

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল সার্ভিস (এনএস) ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে চলতি বছর (প্রতিষ্ঠাকাল: ১৪ মার্চ ১৯৬৭)। এ উপলক্ষে এভরিডে গার্ডিয়ানস: ফিফটি ইয়ার অব ন্যাশনাল সার্ভিস ইন সিঙ্গাপুর’স হোম টিম নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ে মলাটবন্দী হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির পথচলার নানা সাফল্যগাথা। সেখানেই জায়গা হয়েছে নাবেলের কৃতিত্বের কথা। ‘আ বেঙ্গলি ব্রিজ’ শিরোনামে নাবেলের ওপর প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে বইটির ৯৪-৯৭ পৃষ্ঠায়। ৩ নভেম্বর বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সেইন লুং। শুধু স্মরণিকায় নয়, তাঁকে নিয়ে খবর প্রকাশ করেছে সিঙ্গাপুরের ্য স্ট্রেইটস টাইমস পত্রিকাও।

সিরাজগঞ্জ টু সিঙ্গাপুর

১৯৯৫ সালে নাবেল আল মাসরির জন্ম সিরাজগঞ্জে। সেখানেই কেটেছে এক বছর। ১৯৯৬ সালে মা মোর্শেদা তাজনীমের কোলে করে চলে যান সিঙ্গাপুর। নৌযান প্রকৌশলী বাবা আবদুল হান্নান ছিলেন আগে থেকেই সিঙ্গাপুরপ্রবাসী। সিঙ্গাপুরের স্কুলেই তাঁর হাতেখড়ি। ২০০৫ সালে পেয়েছেন নাগরিকত্ব। সিঙ্গাপুর পলিটেকনিক থেকে যন্ত্র প্রকৌশলে পড়েছেন। বাধ্যতামূলক এই নাগরিক কর্তব্য শেষ করে ভর্তি হতে চান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে পর্বও অনেকটা গোছানো। নাবেল বললেন, ‘সিঙ্গাপুর ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে যান্ত্রিক নকশা (মেকানিক্যাল ডিজাইন) বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। এটা আমার পছন্দের বিষয়। এ বিষয়েই স্নাতক হতে চাই।’

পরিবারের সঙ্গে
পরিবারের সঙ্গে

আপাতত তাঁর পরিকল্পনা বাংলাদেশের কক্সবাজার ঘিরে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত ঘুরে দেখতেই এবার বাংলাদেশে আসা। নাবেল বলেন, ‘আসার সময় ট্যুর প্ল্যান করেই এসেছি। তিন দিনের জন্য কক্সবাজার যাব, ইচ্ছেমতো ঘুরব। বলা যায় শুধু কক্সবাজারে যাব বলেই একা চলে এসেছি।’