রূপা আমার বড় বোন

সেলফিতে দুই বোন রূপা ও পপি। এই ছবি এখন শুধুই স্মৃতি
সেলফিতে দুই বোন রূপা ও পপি। এই ছবি এখন শুধুই স্মৃতি

‘রূপা আপুর সঙ্গে মাঝে মাঝে খুনসুটি হতো, রাগ-অভিমান হতো। অভিমানে ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিতাম। রুপা আপু প্লেটে ভাত মেখে মুঠো করে মুখে তুলে দিতেন। মমতাভরা কণ্ঠে গাইতেন, “তুই আমার ছোট বোন, তুই আমার প্রাণমন; এই মনে গাঁথা আছে, এখন তো আমরা দুজন।” মুহূর্তেই রাগ গলে যেত। আমিও গেয়ে উঠতাম, “তুই আমার বড় বোন, তুই সুখ তুই জীবন, মনে মনে গাঁথা আছে, এখন তো আমরা দুজন।” এখন আর কেউ আদর করে বুকে টেনে নেয় না। বড় বোন হলেও বাবার শাসন, মায়ের স্নেহ-আদর দিয়ে আপু আমাদের বড় করেছিল। এক আত্মাই যেন ছিল আমাদের। রূপা আপুকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা আমার জন্য বড্ড কষ্টের। আপুর শূন্যতা ভুলতে পারছি না। আপুর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে এখন বাঁচার চেষ্টা করছি।’

 টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় চলন্ত বাসে গণধর্ষণ ও বর্বর খুনের শিকার বড় বোন রূপা খাতুনের (২৫) কথা বলতে বলতে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়েন ছোট বোন পপি খাতুন (২৩)।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার আসানবাড়ী গ্রামের বাবাহারা দুই বোন রূপা ও পপি বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। রূপা কাজ করতেন ময়মনসিংহে। গত ২৫ আগস্ট বগুড়ায় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময় রাতে ময়মনসিংহগামী যাত্রীবাহী বাসে গণধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রূপা। রূপা হত্যার পর তাঁর দরিদ্র পরিবারে আর্থিক অনিশ্চয়তা নেমে এলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ছোট বোন পপি খাতুনকে সরকারি ওষুধ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগসের বগুড়া উৎপাদনকেন্দ্রের অফিস সহকারী পদে চাকরির আশ্বাস দেন। সে অনুযায়ী পপি ১৫ নভেম্বর অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগসের বগুড়া উৎপাদনকেন্দ্রের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগে ক্যাজুয়াল অফিস সহকারী হিসেবে যোগ দেন। ১৯ নভেম্বর কথা হয় পপির সঙ্গে।

নতুন চাকরিতে যোগ দিয়ে পপি খাতুন মা হাসনাহেনা পারভীন ও ছোট ভাই রোমান হোসেনকে নিয়ে বগুড়া শহরের কলোনি এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে উঠেছেন। বর্গাচাষি বাবা জেলহজ প্রামাণিক দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভুগে ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর মারা যান। ছোট ভাই রোমান উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও টাকার অভাবে ভর্তি হতে পারেননি।

রূপার ছোট বোন পপি খাতুন ছবি: সোয়েল রানা
রূপার ছোট বোন পপি খাতুন ছবি: সোয়েল রানা

রূপা বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) শেষ করে ঢাকা আইডিয়াল কলেজে আইনে ভর্তি হয়েছিলেন। পপি নাটোর সরকারি এনএস কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সম্মান পাস করেছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর সব দায়িত্ব ছিল রূপার। আজ তা পপির। প্রতিদিন অন্তত আট-দশবার মুঠোফোনে কথা হতো দুই বোনের। রূপাই বেশি ফোন দিতেন।

রূপার হত্যাকাণ্ডের খবর শোনার দিনটি জীবনের ভয়ংকর এক সময় পপির জন্য। পপি বললেন, ‘কদিন পর ছিল ঈদুল আজহা। বাবার মৃত্যুর পর কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। রূপা আপু বলেছিলেন, “পপি ঈদের বেতন-বোনাস পেলে বাড়িতে মা আর দাদাকে (বড় ভাই) একটা সারপ্রাইজ দেব। বিকাশে কোরবানির টাকা পাঠাব। তাঁরা খুব খুশি হবেন।” নিজেরা কোরবানি দিতে পারব ভেবে আমারও খুশি লেগেছিল।’

 শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করে বাড়ির কাছাকাছি কোনো কলেজে শিক্ষকতা করার ইচ্ছা ছিল রূপার। পাশাপাশি বাড়িতে থেকে মা ও ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করবেন এমনটাই ভেবেছিলেন। পপি বলেন, রাষ্ট্রের কাছে এখন একটাই আকুতি—নারী ও শিশু আদালতে নয়, রূপা ধর্ষণ ও হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হোক। দ্রুততম সময়ের মধ্যে খুনিদের ফাঁসির আদেশসহ তা কার্যকর করা হোক। তাহলে আপুর আত্মা শান্তি পাবে, আমরাও স্বস্তি পাব।’