জেরিনের 'হার স্টোরি'

হার স্টোরি বই হাতে জেরিন মাহমুদ হোসেন l ছবি: খালেদ সরকার
হার স্টোরি বই হাতে জেরিন মাহমুদ হোসেন l ছবি: খালেদ সরকার

মেয়েটি যখন ছোট ছিল মায়ের হাত ধরে ছবি আঁকা শিখতে যেত, এখনো সেই স্মৃতি তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা সময়। বড় হয়েও ছবির প্রতি প্রবল আগ্রহ। ঢাকার স্কলাস্টিকা স্কুল থেকে এ লেভেল পাস করে পড়তে চলে গেল যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কলেজে। অর্থনীতিতে স্নাতক করার সময় সুযোগ পেলেই ছবি আঁকার ওপর বিভিন্ন কোর্স করতে থাকে। এই স্মিথ কলেজে পড়ার সময় জীবনবোধে নতুন এক ভাবনা এল। মেয়েদের কলেজ এটি। ধরা যাক কোনো নাটক হচ্ছে, সেটার অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে কলাকুশলী সবাই মেয়ে। সে সময়ই গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড বইটি পড়েন তিনি। মন নতুন করে আলোড়িত হয়। অনেক স্বপ্ন দেখার সেই মেয়ে নিজের একেকটা স্বপ্ন পূরণ করার জন্য কাজ করতে থাকেন।

তাঁর আরেকটি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এবারের ঢাকা লিট ফেস্টে। শিশুদের জন্য বাংলাদেশের ২১ জন সাহসী নারীর ২০টি গল্প নিয়ে তাঁর সম্পাদনায় ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে হার স্টোরি: অ্যাডভেঞ্চারস অব সুপারগার্লস বইটি। পরে বাংলায় অনূদিত বইও পাওয়া যাবে। যাঁকে নিয়ে এত কথা তিনি হার স্টোরি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জেরিন মাহমুদ হোসেন। একই সঙ্গে স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানি নামে একটি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিং ফার্মের পার্টনার এই চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট।

পাঁচ বছর আগে হার স্টোরি ফাউন্ডেশনের ভাবনাটা মাথায় আসে তাঁর। ছেলেদের নানা ধরনের ক্লাব থাকে, প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক আছে। সে অর্থে নারীদের তেমন কোনো প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক নেই। যেখানে তাঁরা নিজেদের কথা বলবে, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে ও নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করবে। ২০১৬ সালের ৮ মার্চ এটি চালু হয়। জেরিন বললেন, ‘তিন বছর আগে করতে চেয়েছিলাম। আমার নানি শামসুন্নাহার রহমান মারা যাওয়ায় ওলটপালট হয়ে গেল। আমার জীবনে দাদি-নানির খুব প্রভাব। হার স্টোরি নারীদের নিয়ে কাজ করবে। প্রথম কাজ হিসেবে বইটি প্রকাশ করার কথা ভাবি।’

ইতিহাসে নারীদের ভূমিকাও অনেক। কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে অত তথ্য খুব একটা পাওয়া যায় না। হার স্টোরি বইটি করার সময় আরও বেশি মনে হয়েছে জেরিনের। খনার কথাই ধরা যাক, এই নারীকে নিয়ে খুব বেশি তথ্য কোথাও নেই। তাই বইটিতে খনার কথাও যেমন আছে, আবার বাংলাদেশের এভারেস্টজয়ী প্রথম নারী নিশাত মজুমদারের কথাও আছে। বিশিষ্ট নারীদের উপস্থাপনও ভিন্নভাবে করা হয়েছে। কাল্পনিক একটি চরিত্র ‘অমিয়া’ নামের ছোট্ট একটি মেয়ে এই  নারীদের গল্প বলে। শেষে দেখা যায় সে তার মাকেও এঁদের মতো একজন সাহসী নারী ভাবে। মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্পটি পড়ার পর পাঠকের মনও আর্দ্র হবে। বইয়ে ব্যবহৃত অলংকরণ বইটিকে নান্দনিক করে তুলেছে। বইটি নোকতা প্রকাশন, পাঠক সমাবেশ ও বাতিঘরে পাওয়া যাবে। রকমারি ডটকমেও পাবেন।

শিশুদের জন্য কেন? উত্তরে জেরিন বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে বাড়ির মেয়েটি যেমন নারীদের অনুপ্রেরণার গল্প জানবে, তার অধিকারের কথা জানবে। তেমনি ছেলেটিও জানতে পারবে। আমাদের পরিবারে আমার মা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট পারভীন মাহমুদ, নানি ছিলেন সমাজকর্মী, দাদি ব্যবসা দেখতেন—সবাইকে দেখে কাজের অনুপ্রেরণা পেয়েছি। পরিবারের সমর্থন খুব দরকার একটা মেয়ের এগিয়ে যাওয়ার জন্য। যা আমি আমার পরিবার থেকে পেয়েছি। স্বামী ব্যবসায়ী জাভেদ হোসেনও আমার সব সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা করেন, আমিও করি।’

জেরিন পরে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর করার পর নিউইয়র্কের মেয়র অফিসে বাজেট কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানে সিপিএ (সার্টিফায়েড পাবলিক অ্যাকাউন্ট্যান্ট) পাস করেই ক্ষান্ত হননি, দেশে ফিরে সিএ পাসও করেন। তিনি গাব্রিয়েল মার্কেজের এতই ভক্ত যে নিজের একমাত্র সন্তানের নামও রেখেছেন গ্যাব্রিয়েল হোসেন।

জেরিন মাহমুদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম নারীর ক্ষমতায়ন বলতে কী বোঝেন—উত্তরে বলেন, ‘নিজের পছন্দ নিজে বাছাই করা, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া।’

প্রতিটি মেয়েরই তাঁর গল্প বা হার স্টোরি হয়ে উঠুক অনুপ্রেরণার। এমনটা প্রত্যাশা তাঁরও, আমাদেরও।