আমরা তিরন্দাজ

তিরন্দাজ মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে l ছবি: সংগৃহীত
তিরন্দাজ মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে l ছবি: সংগৃহীত

কথাটি প্রাচীন পুরাণের বীরযোদ্ধা, তিরন্দাজ চিত্রাঙ্গদার। আর বাংলাদেশের বর্তমানের চিত্রাঙ্গদারা কেমন আছে? বলা হচ্ছে তীর–ধনুকের খেলা আর্চারি যারা খেলে সেই তিরন্দাজদের কথা। বিশ্বের ১১৪টি দেশ এটা খেলে থাকে। ঢাকায় এখন চলছে এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ-২০১৭। এতে বাংলাদেশসহ অংশ নিচ্ছেন ৩০টি দেশ।

বাংলাদেশের আর্চারির পথচলা শুরুতে মসৃণ ছিল না। তারপর অর্থনৈতিক সংকট ও নানা কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে যেভাবে সাফল্যের পথে হাঁটছে, তা এক রকম ইতিহাস। আর্চারিই একমাত্র খেলা বাংলাদেশে, যা শত বাধা সত্ত্বেও দ্রুত উন্নতির পথে হাঁটছে। নানা দেশের বিভিন্ন গেমসে এ খেলা থেকে এসেছে সোনা, রুপা, ব্রোঞ্জসহ অসংখ্য পদক। ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মের জন্য আর্চারি এক বিশাল সম্ভাবনাময় সোনালি স্বপ্নের দ্বার। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য, যা তাদের দেখিয়ে দেবে ভবিষ্যতে অসাধারণ হয়ে ওঠার পথ। যে পথে এখন হাঁটছে বিউটি, শ্যামলী, ইতি, শাপলা, হীরামণি, বন্যার মতো স্বর্ণজয়ী, প্রত্যাশী তিরন্দাজরা। যাদের ঝুলিতে রয়েছে আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

সব যেন রূপকথার মতো

আর্চারিতে আজ ছেলেদের পাশাপাশি যে মেয়েরা খেলছে, দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছে, তাদের অনেকে কল্পনাই করেনি গ্রামের বাইরে পা রাখতে পারবে। শাপলার কথাই ধরা যাক, যে কিনা রাশিয়ায় স্বর্ণপদক অর্জন করেছে। তার ভাষায়, ‘জীবনে নিজ জেলার বাইরে যাইনি, বিদেশ তো দূরের কথা, কোনো দিন প্লেনে উঠতে পারব, তা কল্পনাই করিনি। অথচ আজ আর্চারি খেলতে এসে যেমন সোনা জয় করেছি, তেমনি রাশিয়ার মতো আরও কত দেশ ঘুরলাম। এ জন্য আমার স্কুল, পরিবার সবাই গর্ব করে। আমার খুব ভালো লাগে।’

ইতি খাতুনের তো খেলাটি প্রথম দেখেই খুব আগ্রহ জন্মে। পরিবারের অনেক বাধা কাটিয়ে জেদ করে আর্চারিতে যোগ দেয়। আগ্রহ ও পরিশ্রমের ফলে এখন জাতীয় দলে খেলছে। তার ইচ্ছা, ভবিষ্যতে বিশ্বের ১ নম্বর তিরন্দাজ হয়ে এক দিন বাংলাদেশের জন্য সোনা জয় করে আনবে অলিম্পিক থেকে। এ রকম আরও গল্প আছে নাসরিন, আফরিন, রোকসানা, তাসনুভা, রাবেয়াদের। তারা মনে করে, বাবা–মা, শিক্ষকেরা যদি উৎসাহ দেন, তাহলে বেশি বেশি মেয়ে আর্চারিতে আসবে। এর পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যাওয়া যাবে নিশ্চিন্তে। কারণ, এখানকার পরিবেশ যেন সবাই একটা পরিবারের মতো। নিশিথ দাস, ফারুখ ঢালী, জিয়ার মতো কোচ ও জাজ রয়েছেন এখানে। তাঁরা অভিভাবকের  মতোই আমাদের আগলে রাখেন। আমরা নতুন মেয়েদের স্বাগত জানাই আর্চারি পরিবারে।

প্রধান কোচ নিশিথ দাস মনে করেন, আর্চারিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে প্রথমে সবাইকে জানাতে হবে খেলাটার সম্ভাবনা। আর্চারিতে এলে অনেক আন্তর্জাতিক খেলায় অংশগ্রহণ করা যায়। বর্তমানে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কারণ, বিভিন্ন সংস্থায় আর্চারি খেলোয়াড়দের চাকরির সুযোগ আছে খেলোয়াড় কোটায়। 

যেভাবে শুরু একজন তিরন্দাজের পথচলা

একজন তিরন্দাজের আর্চারি খেলা শুরু হয় বিগেনার বো দিয়ে। প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন জেলা ইয়ুথ আর্চারি প্রোগ্রাম ক্যাম্প শুরু হয়। সেখান থেকে ১০-১৫ জনকে বাছাই করে তারপর তাদের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তারপর অনুশীলন ও বিভিন্ন টুর্নামেন্ট পর্বে পর্যায়ক্রমে অংশগ্রহণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী একজন তিরন্দাজ জাতীয় দলে সুযোগ পায়। সবকিছুই এখানে করা হয় পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে। যদি অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বেশি হতো, আরও অনেক সাফল্য আসত।

আশার কথা, এ অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা চাই, আর্চারিতে বেশি বেশি মেয়ে আসুক। এর জন্য বেশি বেশি আয়োজন ও গণমাধ্যমে  প্রচার জরুরি ভূমিকা পালন করতে পারে। যখন একজন মেয়ে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে চায়, তখন মা-বাবা হয়তো চিন্তায় পড়েন। মেয়ে কোথায় যাবে, থাকবে বা পরিবেশ কেমন হবে? নিরাপদ কি না? সেই চিন্তা একদমই করতে হবে না আর্চারিতে এলে। বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশনের সভাপতি মইনুল ইসলাম মনে করেন, মেয়েরা আর্চারিতে আসতে চাইলে তাদের জন্য রয়েছে নারীবান্ধব পরিবেশ ও সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত। সামনে আর্চারির সোনালি দিনের অপেক্ষায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন কোচ, জাজদের পাশাপাশি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজীব উদ্দিন, সহকারী সম্পাদক কামরুল ইসলামসহ অন্যরা।

আমরা চাই আর্চারিতে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও আসবে। তাদের প্রতিভা দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় হয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।

লেখক: ন্যাশনাল জাজ, বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশন