বিলেতের কনিষ্ঠ কাউন্সিলর শরিফা

ইংল্যান্ডের ডারলিংটন বারা কাউন্সিলের উপনির্বাচনের প্রচারণায় শরিফা রহমান। ছবি: সংগৃহীত
ইংল্যান্ডের ডারলিংটন বারা কাউন্সিলের উপনির্বাচনের প্রচারণায় শরিফা রহমান। ছবি: সংগৃহীত

তাঁর বয়স সবে ১৮ বছর। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন। এরই মধ্যে শরিফা রহমানের নামের পাশে ‘তুখোড় রাজনীতিক’ তকমাটা বসে গেছে। যাবেই না বা কেন, এ বয়সেই যে তিনি বিলেতি শহরের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। খবরটা হয়তো অনেকেরই জানা, ১৭ নভেম্বর ইংল্যান্ডের ডারলিংটন বারা কাউন্সিলের উপনির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই তরুণী। কাঁধে নিয়েছেন সে কাউন্সিলের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, পরিবেশ সুরক্ষাসহ আরও অনেক বিষয় দেখভালের দায়িত্ব।

শরিফা রহমান
শরিফা রহমান

১৮ বছর বয়সে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন এমন মানুষ হয়তো যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে আরও পাওয়া যাবে। কিন্তু তা হাতে গোনা। শরিফার কথাই ধরুন না, তিনি যে ডারলিংটন এলাকায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন, সেই এলাকার ইতিহাসে শরিফা কনিষ্ঠতম কাউন্সিলর।

চমকের ব্যাপার আছে আরও। শ্বেতাঙ্গ–অধ্যুষিত ডারলিংটনে মোট ৫০ জন কাউন্সিলরের মধ্যে একমাত্র অশ্বেতাঙ্গ কাউন্সিলরও এই বাঙালি কন্যা। এ বারার (কাউন্সিলের আরেক নাম) একমাত্র মুসলিম কাউন্সিলরও তিনি। প্রথম কোনো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জনপ্রতিনিধি তো বটেই!

সব প্রথমের শরিফাকে উজ্জ্বল আলোয় এনেছে তাঁর মেধা ও সমাজ বদলের প্রতিশ্রুতি। অভিজ্ঞদের পেছনে ফেলে, ১৮ বছর বয়সী এক তরুণীর পক্ষে লেবারের মতো প্রভাবশালী দলের মনোনয়ন অর্জন করাও চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। গত ২৫ নভেম্বর সেসব নিয়েই কথা হলো শরিফা রহমানের সঙ্গে। টেলিফোন আলাপে তিনিও শোনালেন নিজের এগিয়ে চলার গল্প।

রাজনীতিতে যেভাবে

লেবার নেতা জেরেমি করবিনের সঙ্গে
লেবার নেতা জেরেমি করবিনের সঙ্গে

শরিফা রহমান তখন কুইন এলিজাবেথ সিক্সথ ফর্ম কলেজে এ লেভেল পড়েন। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে বর্ণবাদবিরোধী সচেতনতা তৈরির জন্য গড়ে তোলেন ইয়াং অ্যাকশন গ্রুপ। এই দলের প্রচেষ্টায় একসময় ডারলিংটনে যাত্রা শুরু হয় বর্ণবাদবিরোধী সংগঠন ‘স্টেপ আপ টু রেইসিজম’-এর শাখা।

বর্ণবাদবিরোধী সংগঠন কেন? শরিফা বলেন, ‘অভিবাসী পরিবারের সন্তান হিসেবে জীবনের কঠিন বাস্তবতাগুলো খুব কাছ থেকে দেখেছি। সমাজের বৈষম্য, বর্ণবাদ ও কুসংস্কারের নানা রূপও আমাকে আলোড়িত করত। ছোটবেলাতেই উপলব্ধি করেছি, এটি বন্ধ করতে সংঘবদ্ধ হতে হবে।’

শুধু এই বোধই নয়, তিনি বুঝে গিয়েছিলেন রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ছাড়া নিজের মতামত তুলে ধরার সুযোগ নেই। তাই তিনি বর্ণবাদবিরোধী সভা, সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিতে ছুটে যেতেন লন্ডন, নিউক্যাসলসহ বিভিন্ন শহরে। এ সুবাদে একান্ত সাক্ষাতের সুযোগ পেতেন লেবার নেতা জেরেমি করবিন, ডায়ান অ্যাবোটসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের। এই নেতাদের সংস্পর্শ তাঁকে অনুপ্রেরণা জোগায় রাজনীতির ময়দানে আসার। যোগ দেন লেবার পার্টিতে। তখন বয়স ১৬।

এগিয়ে চলা

বর্ণবাদবিরোধী ‘ডারলিংটন ইয়াং লেবার গ্রুপ’ যখন যাত্রা শুরু করল, তখন থেকেই তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। বৈষম্য ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকার জন্য ২০১৬ সালে ডারলিংটন শহরের সম্মানসূচক পদক ‘ইয়াং সিটিজেন অব দ্য ইয়ার’ দেওয়া হয় তাঁকে। নগরের উন্নয়নে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখছেন এমন ব্যক্তিদের স্বীকৃতি দিতে ‘বেস্ট অব ডারলিংটন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পদক দেওয়া হয়।

স্থানীয় এমপি জেনি চ্যাপম্যানের সহযোগিতায় ডারলিংটনে শরিফা সম্প্রতি চালু করেছেন একটি ‘পিস ক্যাম্পেইন’ (শান্তির পক্ষে প্রচারাভিযান)। যার মূল লক্ষ্য স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং বর্ণবাদের কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি। পুলিশ বিভাগ এ কার্যক্রমে নিয়মিত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বলে জানান শরিফা। এসবের পাশাপাশি শরিফা একটি মোবাইল ফোন সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকসেবা কেন্দ্রে খণ্ডকালীন কাজ করছেন।

যেভাবে কাউন্সিলর

গত অক্টোবরের কথা। স্বাস্থ্যগত কারণে ডারলিংটন বারা কাউন্সিলের ‘রেডহল অ্যান্ড লিংফিল্ড’ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হ্যাজেলডিন পদত্যাগ করেন। শূন্য হয় আসনটি। তত দিনে ‘এ লেভেল’ পরীক্ষা শেষ হয়েছে শরিফার। সক্রিয় রাজনীতিক শরিফা নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। লেবার দলের প্রার্থী হওয়ার লড়াইয়ে নামেন। প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করে বাগিয়ে নেন মনোনয়ন। তারপর সভা, প্রচারপত্র বিলি আর দরজায় কড়া নেড়ে নেড়ে ভোটের প্রচারণা চলতে থাকে।

স্থানীয় সাংসদের সঙ্গে শরিফা
স্থানীয় সাংসদের সঙ্গে শরিফা

ভোটাররা নিরাশ করেননি শরিফাকে। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, গ্রিন পার্টি এবং ইউকে ইনডিপেনডেন্ট পার্টির প্রার্থীদের হারিয়ে বিজয় নিশান ওড়ান শরিফা। ভোটের হিসাবে তিনি পেয়েছিলেন ২৪৯টি ভোট, যা মোট ভোটের ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

ভবিষ্যৎ ভাবনা

শরিফার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বিভাগ (কাউন্টি) ডারহামের ডারলিংটনে। লোকমান খান ও সাজিদা রহমান দম্পতির সাত সন্তানের মধ্যে ষষ্ঠ শরিফা। বাংলাদেশে তাঁদের আদি বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার বরমরা গ্রামে।

শরিফা বললেন, ‘রাজনীতিকে পুরোপুরি পেশা হিসেবে নেব কি না, এখনো ভাবি না। তবে রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করতে চাই। সেটি স্থানীয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই।’

পড়াশোনার পাশাপাশি কাউন্সিলর হিসেবেও যেন নিজের নিয়মিত দায়িত্ব পালন করতে পারেন, তাই স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা তাঁর।

আলাপের শেষে প্রশ্নটা জানতেই চাইলাম, বাংলাদেশে কবে যাচ্ছেন? ‘বাংলাদেশি পরিবারের সন্তান হিসেবে সে দেশের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরেই আসে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি অনেকের মতো আমাকেও ভাবায়।’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে বেড়াতে যাব।’