আকাশপথে পোপকে নিয়ে

ঢাকায় নামছেন পোপ ফ্রান্সিস। ছবিতে দেখা যাচ্ছে এই বিমানের চালক ক্যাপ্টেন তাসমিন দোজাকেও l ছবি: রয়টার্স
ঢাকায় নামছেন পোপ ফ্রান্সিস। ছবিতে দেখা যাচ্ছে এই বিমানের চালক ক্যাপ্টেন তাসমিন দোজাকেও l ছবি: রয়টার্স

‘পোপকে ইয়াঙ্গুন থেকে আনার চিঠি আমি পেয়েছিলাম ২৫ নভেম্বর। এর পর থেকে তাঁকে নিয়ে আমি ইন্টারনেটে পড়াশোনা করি। ঢাকার হলিক্রস কলেজে আমি পড়েছি। তাই সিস্টার ও কলেজের প্রিন্সিপালদের নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার জীবন সম্পর্কে জানতাম। সে কারণে পোপের একটি কাল্পনিক চরিত্র আমার সামনে বারবার চলে আসছিল।’ এই কথা দিয়ে আলাপ শুরু করলেন ক্যাপ্টেন তাসমিন দোজা।

পোপ এবং তাঁর সঙ্গী ৭০ জন যাত্রী নিয়ে উড়োজাহাজ মেঘদূতকে ইয়াঙ্গুন থেকে ঢাকায় উড়িয়ে নিয়ে আসেন ক্যাপ্টেন তাসমিন দোজা। বাংলাদেশ বিমানের অভিজ্ঞ পাইলট। মেঘদূতে করে প্রায় আড়াই ঘণ্টার আকাশযাত্রায় তিনি কাছ থেকে দেখেছেন পোপ ফ্রান্সিসকে। সেই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন ক্যাপ্টেন তাসমিন দোজা।

৩০ নভেম্বর দুপুর। মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দরের রানওয়েতে একজন বিশেষ যাত্রীর অপেক্ষায় বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ ‘মেঘদূত’। লালগালিচা বিছানো একেবারে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজের মূল দরজা পর্যন্ত। সেই দরজার ফাঁক দিয়ে রোদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে ভেতর পর্যন্ত। সেই আলো দুই পাশে সরিয়ে ধীরে ধীরে ‘মেঘদূতে’ চলে এলেন সেই বিশেষ যাত্রী। তিনি ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু, ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রপ্রধান পোপ ফ্রান্সিস। বয়সের ভারে শরীরটা সামান্য ঝুঁকে পড়েছে। কিন্তু বিমানে ওঠার সময় দীর্ঘদেহী পোপের মুখে ছিল হাসি। এই হাসিমুখেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছেন শান্তির বার্তা। তিন দিনের সফরে শান্তির বার্তা নিয়েই তিনি আসেন বাংলাদেশে। পোপ ফ্রান্সিসকে বহন করতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ ‘মেঘদূত’ পাঠায় ইয়াংগুনে।

সত্যিই যখন পোপ ফ্রান্সিস মেঘদূতে এলেন, তাসনিমের সব কল্পনা অন্য রূপ পেতে থাকল। তাসমিন দোজা বললেন, ‘আমরা সবাই উৎসাহ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম দরজার সামনে। বিশেষ ফ্লাইটে অতিরিক্ত পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন নিক্সন। আরও দুজন নারী ক্রু ছিলেন, যাঁরা খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। তাঁদের উচ্ছ্বাসটা ছিল অন্য রকম। পোপ কোনো কথা না বলে আমাদের সঙ্গে হাত মেলালেন। জায়গা ছোট হওয়ায় আড়ালে দাঁড়ানো ফার্স্ট অফিসার সুমায়লার সঙ্গেও হাত মেলালেন পোপ।’

এরপর পোপ তাঁর জন্য নির্ধারিত এ-১ নম্বর আসনে বসেন। ‘মেঘদূত’ আকাশে উড়াল দেওয়ার পর ভ্যাটিকানের এক কর্মকর্তা ককপিটে এসে ক্যাপ্টেন তাসমিনসহ ছবি তোলার কথা জানান। ‘আমরা একজন একজন করে পোপের সঙ্গে ছবি তুলতে তাঁর আসনের পাশে যাই। তখন পোপের মুখে সেই অসাধারণ হাসি। কিন্তু কথা নেই। ছবি তুললাম। পোপের চেহারাই বলে দেয় তাঁর মধ্যে নেই কোনো অহংকার, কোনো দাম্ভিকতা।’

ছবি তোলার পর্ব সেরে ক্যাপ্টেন তাসমিন দোজা ও অন্যরা চলে যান ককপিটে। ‘মেঘদূত’ তখন ৩২ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে আসছে ঢাকার দিকে। সে সময় পোপকে খাবার পরিবেশন করা হলো। সবই বিশেষ খাবার। এর তালিকা ভ্যাটিকান দূতাবাস থেকে নির্ধারণ করা হয়েছিল। আট ধরনের খাবার। এর সঙ্গে আরও ১০টি অতিরিক্ত খাবার দেওয়া হয়। চিকেন বিরিয়ানি, পোলাও, রোস্টেড চিকেন, বিশেষ ধরনের সালাদ, চিকেনকারি, ১০ রকমের ফল ইত্যাদি। তবে পোপ ফ্রান্সিস চিকেন আর সেদ্ধ ভাত খেয়েছিলেন। অন্য খাবার থেকে অল্প করে মুখে নেন। তাসমিন জানালেন, পোপ বেশি মসলাযুক্ত খাবার খান না। তাই কম মসলার খাবার বেছে নিয়েছিলেন।

বিমানচালক তাসমিন দোজা
বিমানচালক তাসমিন দোজা

ইয়াঙ্গুন থেকে ঢাকায় আসতে সাধারণত পৌনে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু প্রোটোকল কর্মকর্তা আড়াই ঘণ্টা সময় নিয়ে ঢাকায় আসতে বলেছিলেন। ক্যাপ্টেন তাসমিন দোজা বললেন, ‘আমরা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ইয়াঙ্গুন আসা-যাওয়া করি। কিন্তু পোপকে আড়াই ঘণ্টায় আসতে বলা হয়। এর কমবেশি হলে চলবে না। তাই ঢাকার আকাশে আসার পর সোজা উত্তর দিকে ময়মনসিংহের দিকে গিয়ে আবার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের পথে আসি। বেলা তিনটার দিকে ঢাকায় অবতরণ করি। ফেরার  সময় আবারও আমরা দরজার কাছে দাঁড়াই। তখনো পোপের মুখে মায়াবী সেই হাসি। আবারও হাত মেলালেন তিনি।     এবারও কোনো কথা নেই। কিন্তু সেই হাসিতে কত কথা যেন বলে গেলেন। হাসির মধ্যেই তো ছিল পোপের শান্তির বার্তা।’

বাবা সামসুদ্দোজা ছিলেন বিমানের পাইলট। তাই তাসমিনেরও ইচ্ছে জাগে আকাশে ওড়ার। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ বিমানের ফার্স্ট অফিসার হিসেবে যোগ দেন তিনি। তাঁর ছোট ভাইও বিমানের পাইলট। ক্যাপ্টেন তাসমিন দোজার শুরুটা হয় এটিপি মডেলের উড়োজাহাজ দিয়ে। ১৯৯৮ সাল থেকে বসেন এয়ারবাস ৩১০-এর ককপিটে। ২০০০ সালে শুরু করেন এফ-২৮ উড়োজাহাজ চালানো। আর ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চালিয়ে আসছেন ১৬২ জন যাত্রী ধারণক্ষমতার বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ।

কর্মজীবনে কত ধরনের কত পেশার মানুষকে বিমানের যাত্রী হিসেবে পেয়েছেন পাইলট তাসমিন। কিন্তু শান্তির দূত হিসেবে যিনি পরিচিত সেই পোপকে বহন করা বিমান চালনা করাটা নিশ্চয়ই তাঁর জীবনের বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়েই থাকবে।