একই সঙ্গে জন্ম হয় বিশেষ মায়ের

বিশেষ শিশু পশলার মা নাজনীন আখতার। যে শিশুকে দিতে হয় মায়ের বিশেষ যত্ন, বিশেষ সময়, বিশেষ শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ। প্রথম আলো ফাইল ছবি
বিশেষ শিশু পশলার মা নাজনীন আখতার। যে শিশুকে দিতে হয় মায়ের বিশেষ যত্ন, বিশেষ সময়, বিশেষ শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ। প্রথম আলো ফাইল ছবি

নিঃসঙ্গ নয়, কিন্তু বড় একা এক মায়ের কথা বলব আজ। কোথাও কোনো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর রোগনির্ণয় হলে বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। প্রথমেই তা শিশুর মায়ের জন্য একটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম হয় একজন বিশেষ মায়ের।

সারা পৃথিবীর সবাই ওই শিশুর জন্মের জন্য আকারে-ইঙ্গিতে, সরাসরি, সোজাভাবে অথবা বাঁকাভাবে একটি কথাই জানাবে, বোঝাবে এবং আলোচনা করবে-এ রকম একজন শিশুর জন্মের জন্য একমাত্র মা-ই দায়ী। সবাই মিলে প্রশ্ন করবে, তোমার বাচ্চা কথা বলে না কেন? ও নিজে কবে খেতে শিখবে? ও স্বাভাবিক বাচ্চাদের সঙ্গে খেলে না কেন? ও কবে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে পারবে? আশপাশের বিজ্ঞজনের কথা শুনে মনে হয়, মা যেন জানতেন যে তাঁর এ রকম একটি বাচ্চা হবে। নতুন মাকে সব প্রশ্নের উত্তর যেন জানতেই হবে। কী করলে বাচ্চাটি স্বাভাবিক হবে, বড় হয়ে কেমন হবে, মারামারি বা ভাঙচুর করবে না তো? নতুন মাকে এসব প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে সবাই যেন খুব শান্তি পায়, এক অপার পাশবিক আনন্দ।
যেহেতু এই বাচ্চা ওই মায়ের, তাই বাচ্চার পরিচর্যা থেকে শুরু করে কোনো কিছু মা জানেন না, তা যেন হতেই পারবে না। মায়ের হাতে কোনো দুর্ঘটনা তো একেবারেই কাম্য নয়, মেনে নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এই বাচ্চা নিয়ে মা কেন সামাজিক অনুষ্ঠানে আর দশজনের মতো যেতে পারেন না, তা যেন তাঁর বিশাল অপরাধ। বাবার বাড়িতে সামাজিক অনুষ্ঠানে কী করে বাচ্চা সামলাতে হয়, তা-ও শেখেননি, মানুষের কথা শুনলে মনে হয়, এই মা সামাজিকতা কি তা জানেন?
মায়ের ওপর আরেকটি চাপ থাকেই। সেটা হলো মা তাঁর বাচ্চাকে আলাদা করে রাখতে চান। কখনো কেউ নিজের কাছে জানতে চেয়েছেন কেন এই মায়েরা বাচ্চাকে আলাদা করে রাখতে চান? সত্যি বলতে কি, নিজের এমন বাচ্চা না থাকলে কখনোই বোঝা যাবে না কেন মা তাঁর নাড়ি ছেঁড়া ধনকে নিয়ে মানুষের সামনে আসতে পারছেন না। ওই মায়েরও ইচ্ছা করে অন্য অনেকের মতো নিজের বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে যেতে। মানুষের অমানবিক প্রশ্নবাণ আর নির্দয় দোষারোপ ও সীমিত জ্ঞানে বিজ্ঞের মতো দেওয়া অবাস্তব সমাধানকে উপেক্ষা করে সামাজিকতা করা সম্ভব হয় না। খুব কাছের মানুষেরাও এতটাই নির্দয় আচরণ করে, এতটাই স্বার্থপরতা দেখায় যে তখন ঘরের চার দেয়ালকেই সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মনে হয়।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন অনেক শিশুই কথা বলেতে পারে না, কিন্তু বুঝতে পারে সবই। এই শিশুদের ওপর মানুষের এসব নেতিবাচক আচরণ ও কথা অনেক সময় বিরূপ প্রভাব ফেলে। সেদিকেও যেন কোনো খেয়াল করার সময় কারও নেই।
সারা পৃথিবীর কাছে আমার একটাই প্রশ্ন-কখনো কি এই মাকে অসহায় মনে হয় না? আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ বাবা আর্থিক সহায়তা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে সাহায্যের হাত বাড়ান না। অনেক ক্ষেত্রে এই আর্থিক সহায়তার অংশটাও চুকিয়ে দেন কোনো কোনো বাবা। অনেক বাবাকে দূরে সরে যেতে দেখেছি। তাঁরা ওই বাচ্চার জন্য দুশ্চিন্তা সহ্য করতে পারছেন না, তাই অন্য কোথাও থাকেন। কেউ আবার নতুন সংসার শুরু করার কথাও ভেবে ফেলেন এই চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়।
কিন্তু সেই মা, তাঁর কথা ভাবার যেন কেউ নেই, এই বাচ্চা ফেলে নিজের খাবার বা একটু ভালো থাকার কথা ভাবা যেন পাপ। এ রকম বাচ্চার মা হয়ে কোনো স্বপ্ন দেখার অধিকার নেই। যতক্ষণ বেঁচে আছেন, সব সমস্যার সমাধান যেন মাকেই করতে হবে। মায়ের যেন কোনো চাপ হয় না, তাঁর অসুস্থ হওয়ার কোনো অধিকার নেই-চিকিৎসা, সে তো সোনার হরিণ। একজন শিশু নানা কারণেই বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে জন্মাতে পারে। বাচ্চা সুস্থ হলে যারা সবার আগে ছুটে এসে আত্মীয়ের পরিচয় নিয়ে দাঁড়াত, বাচ্চাটি অসুস্থ হওয়ায় সেই আশপাশের অতি চেনা মুখগুলো দূরে সরে যায়, যেতে যেতে প্রতি মুহূর্তে রক্তাক্ত করে সেই মাকে-যাঁর আসলে খুবই প্রয়োজন একটু বিশ্রামের, আন্তরিক ও নিরাপদ একটি আশ্রয়ের। এখানে সমস্যার সমাধান জানা না থাকলেও থাকবে আশ্বাস-আমি বা আমরা তোমার পাশেই আছি। সমস্যা যত কঠিনই হোক না কেন, পথ যত দুর্গমই হোক না কেন, আমরা থাকব। ও তো আমাদেরই একজন।