ঘুরে দাঁড়াল হাসনা

হাসনা বেগম
হাসনা বেগম

তখনো স্বপ্নগুলো পুরোপুরি তৈরি হয়নি। স্বপ্নগুলো দানা বাঁধছে। কত আর বয়স। আঠারোও হয়নি। কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ঠিক এই সময়েই হুট করে এক ‘লন্ডনি’ পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় হাসনা বেগমের। বিয়েটা সামাজিকভাবেই হয়েছে। তাই এ নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। সমস্যাটা তৈরি হয় যখন হাসনা বেগম জানতে পারেন, বিয়েটা ছিল প্রতারণামূলক। তত দিনে বেশ বেলা গড়িয়ে গেছে। মুঠোয় ধরা স্বপ্নটা হাত থেকে ফসকে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামটাই তাঁর কাছে তখন মুখ্য হয়ে উঠেছে।

হাসনা বেগম ২০১৭ সালে ‘নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী’ হিসেবে মৌলভীবাজারে জেলা পর্যায়ে জয়িতার সম্মাননা পেয়েছেন। এই সম্মাননা তাঁকে হয়তো দশজনের সামনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তাঁর জীবনটা এখনো মসৃণ কোনো পথের মধ্যে নেই। ফেলে আসা জীবনের বিভীষিকা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাঁকে কুরে কুরে ঝাঁজরা করছে। 

হাসনা বেগমের বাড়ি মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার টেংরা গ্রামে। বাবা কুটি মিয়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট হাসনা বেগম পড়ালেখায় ভালো ছিলেন। লেখাপড়া করেই বড় হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। পড়ালেখা ভালোই চলছিল। স্কুলের প্রতিটি শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে এগিয়ে চলছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই বিপর্যয়ের শুরু, যখন দশম শ্রেণিতে নির্বাচনী পরীক্ষার শেষ দিনে বাবা মারা গেলেন। বাবার মৃত্যুতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। এসএসসি পরীক্ষায় স্কুলের ফলাফলের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ২০০৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসিতে উত্তীর্ণ হয়ে রাজনগর ডিগ্রি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় প্রবাসী পাত্রের সঙ্গে বিয়ের আলাপ আসে। প্রতারক ঘটকের ফাঁদে পড়ে ২০০৭ সালে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার এক লন্ডনি পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। বিয়ের কিছুদিন পরই হাসনা বেগমের স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে (হাসনা বেগম) লন্ডনে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান। লন্ডনে নেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন কাগজে তাঁর স্বাক্ষর নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ভাইদের কাছ থেকে চার লাখ টাকা এনে দেওয়ার কথা বলেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন। বলা হয়, চার লাখ টাকা দিলে হাসনা বেগমকে লন্ডনে নিয়ে যাবে। নতুবা তিন-চার বছর লাগবে। হাসনা বেগমের ভাইয়েরা জমি বিক্রি করে দুই কিস্তিতে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা স্বামী ও শ্বশুরের হাতে তুলে দেন।
হাসনা বেগম বলেন, ‘টাকা দেওয়ার কিছুদিন পরই অনুমান করতে পারি, শ্বশুরবাড়ির লোকজন প্রতারক ও অর্থলোভী প্রকৃতির।’ এ ঘটনার পরই হাসনা বেগমের কাছে ধরা পড়ে, স্বামী আগেই আরেকটি বিয়ে করেছেন। সেই স্ত্রী যুক্তরাজ্যে আছেন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন আগের বিয়ের কথা অস্বীকার করেন। শুরু হয় তাঁর ওপর নির্যাতন। পরিবারের কাজের লোক বিদায় করে তাঁকে দিয়ে ঘরের সমস্ত কাজ করানো হয়। হাসনা বেগম এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা দিতে চাইলে তাঁকে বলা হয়, তাঁকে কাজের জন্য নেওয়া হয়েছে। লেখাপড়ার জন্য না। যদিও বিয়ের আগে পড়ালেখার সুযোগ দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। পড়ালেখা করার কথা বলায় তাঁর মাথার চুল কেটে দুই দিন বাথরুমে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। হাসনা বেগমের পড়ালেখার স্বপ্নটা ভেঙেচুরে যায়। নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়লে ভাইয়েরা তাঁকে বাবার বাড়ি নিয়ে আসেন। এরই ফাঁকে স্বামী লন্ডনে চলে যান।
বাবার বাড়িতে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে ভালো আচরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর শ্বশুর আবার তাঁকে নিয়ে যান। কিন্তু কিছুদিন পরই শুরু হয় নির্যাতন। বিভিন্ন সামাজিক উৎসবে ১০-২০ হাজার টাকা চাওয়া হতো। ভাইয়েরা বোনের সংসার টিকিয়ে রাখতে টাকা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কমতি হলেই নির্যাতন চলেছে। হাওর এলাকায় বাড়ি হওয়ায় ডাকাতের ভয় দেখিয়ে স্বর্ণালংকার তাঁদের আয়ত্তে নিয়ে বিক্রি করে দেন। একপর্যায়ে বাবার বাড়ি থেকে নেওয়া আসবাবপত্রও বিক্রি করে ফেলা হয়। এসবের প্রতিবাদ করায় ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবর মিলে তাঁকে মারধর করেন। চড়-থাপ্পড়, লাঠি দিয়ে আঘাত করে একসময় হাওরের পানিতে ফেলে দেন। নির্যাতনে দুর্বল শরীর। এই অবস্থায় সাঁতরে পারে ওঠার সামর্থ্য ছিল না। নৌকার এক মাঝিও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের আপত্তির কারণে পাড়ে নিতে চাননি। কুশিয়ারা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে অনেক লোক ঘটনাটি দেখছিল। পরে পাড়ের লোকজন তাঁকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করেন। একটি বাড়িতে রেখে ভাইদের ফোন দিয়ে নিয়ে তাঁদের হাতে তুলে দেন। হাসনা বেগমের এই করুণ দশা সইতে না পেরে বড় ভাই অসুস্থ হয়ে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন। ভাইয়ের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা চরম খারাপ হয়ে পড়ে।
এই অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে শিক্ষার পথ ছাড়া আর কিছু চোখের সামনে ধরা পড়েনি তাঁর। পড়ালেখা চালানোর সামর্থ্যও নেই। এরপরও কলেজে এসে যোগাযোগ করলে শিক্ষকেরা তাঁকে সহযোগিতা করেন। দুই বান্ধবী ও এক খালাতো ভাইয়ের সহযোগিতায় এবং মায়ের দুটি শাড়ি বিক্রি করে এইচএসসি পরীক্ষা দেন। ২০০৯ সালে মানবিক বিভাগে এইচএসসি উত্তীর্ণ হন। শুরু করেন প্রাইভেট পড়ানো। পাশাপাশি ডিগ্রিতে ভর্তি হন। নারী ও শিশু আদালতে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে নির্যাতনের মামলা করেন। এখনো মামলা চলছে। ২০১২ সালে স্নাতক দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। বর্তমানে সিলেট এমসি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ বর্ষে আছেন।
এর মধ্যে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র, ইন্স্যুরেন্সসহ একাধিক কোম্পানিতে কাজ করেছেন। কিন্তু এসব জায়গায়ও প্রতারিত হয়েছেন। কর্মকর্তারা গ্রাহকদের টাকা আত্মসাত করায় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করেছেন। এখনো ঋণগ্রস্ত আছেন। বর্তমানে রাজনগরের টেংরায় শহীদ সুদর্শন উচ্চবিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন।
হাসনা বেগম বলেন, ‘আমাকে ভাইয়ের পরিবারও দেখতে হচ্ছে। আমি স্বাবলম্বী হতে চাই। স্থায়ী চাকরি দরকার। আমি জীবনসংগ্রামে সব ধরনের কষ্টই অতিক্রম করছি। অতিক্রম করছি সামাজিক প্রতিকূলতা। তবু থেমে যাইনি। আগুনে পুড়ে জীবন থেকে অনেক শিক্ষা পেয়েছি। সেটা কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।’