আঠারো থেকে পঁচিশ জীবনের বড় ক্রান্তিকাল

>

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। শুধু আইন কিংবা বিচারকার্য নয়; ইতিহাস, ভাষা, শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষা—এসব নিয়েও তিনি গভীরভাবে ভাবতেন। স্পষ্ট ভাষায় বলতেন, লিখতেন তাঁর কথামালা। ১১ জানুয়ারি এই গুণী মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৭ সালের ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বক্তা ছিলেন তিনি। ছাত্রদের উদ্দেশে সেদিন তিনি যা বলেছিলেন, সেটিই আজ সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হলো।

আমাদের দেশে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো আঠারো বছর বয়স হলে প্রত্যেক নাগরিক ভোটাধিকার পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব ছাত্রই সেই অধিকার লাভের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক। ভোট দেওয়ার সঙ্গে রাজনীতির একটা সম্পর্ক আছে। ভোটাধিকারপ্রাপ্তদের রাজনীতি থেকে কি সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে রাখা যায়? রাজা ক্যান্যুটের মতো হুকুমও করা চলবে, ‘তিষ্ঠ, হে সমুদ্র, শান্ত হও’। তবে ভোটাধিকার পেলেই সক্রিয় রাজনীতি করার সুযোগ হয় না। সংসদের নির্বাচনে প্রার্থীর পঁচিশ বছর বয়স হতে হবে। আঠারো থেকে পঁচিশ এই সময়কালটা মানুষের জীবনে এক বড় ক্রান্তিকাল। এ-কাল শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির কাল। যে-বয়সে ছাত্ররা মূলত শিক্ষার্থী বা পরীক্ষার্থী এবং সংসদের নির্বাচনপ্রার্থী হওয়ার অবকাশ নেই, সেই বয়সে স্বীয় কর্ম সুচারুরূপে সম্পাদন করার জন্য ও নিজের প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য অধ্যয়নকে তাদের সকল কর্মকাণ্ডের ওপরে স্থান দিতে হবে।

দেশে ছাত্ররাজনীতি আজ এক আকর্ষণীয় লাভজনক পেশা। অর্থ উপার্জন এবং প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তারের আশায় জ্ঞানকবুল করে কিছু-কিছু ছাত্র সেই লাভজনক পেশায় অতিশয়পন্থায় দ্বারস্থ হতে ইতস্তত বোধ করছে না। দেশে আইন ও শৃঙ্খলার যথোপযুক্ত প্রয়োগের অভাবে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষাঙ্গনের কর্তৃপক্ষ থেকে সরকার পর্যন্ত সমাজের বেশ বড় একটা অংশ ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। সন্ত্রাসীদের আশকারা বা আশ্রয় দিয়ে কারও অবশ্য লাভ হচ্ছে না। সন্ত্রাসীরা আত্মহননে খরচ হয়ে যাচ্ছে। দেশের যুবশক্তির এই মহা-অপচয় আমরা রোধ করতে পারব যখন ছাত্ররাজনীতিকে সম্পূর্ণ অলাভজনক করা সম্ভব হবে। বহু গবেষিত বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞানীরা যদি একটি জরিপ করে দেখান, ছাত্ররাজনীতির বদৌলতে দেশ কতটা উপকৃত হয়েছে বা দেশের কতটা অমঙ্গল হয়েছে, তবে আমরা বড় উপকৃত হব।

ধর্মঘট বিষয়টা একসময় ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত হতো। শ্রমিকেরা যাতে করে মালিকের কাছ থেকে তাদের দাবিদাওয়া আদায় করতে পারে তার জন্য কালক্রমে এই ধর্মঘটকে জায়েজ করা হয়। এই ধর্মঘটের সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য গুজরাটি হরতাল শব্দটি আমাদের দোহাই বা দুয়ো দেওয়ার প্রবণতার সঙ্গে মিশে গিয়ে আজ স্থান-অস্থানে বিষচক্রের সৃষ্টি করেছে। পিতৃস্থানীয় শিক্ষকের সঙ্গে সন্তানস্থানীয় ছাত্রের যে-সম্পর্ক, সেখানে ধর্মঘট বা হরতালের কোনো অবকাশ নেই। এই উপমহাদেশ ছাড়া এমন দেশটা আমরা কোথাও খুঁজে পাব না, যেখানে পরীক্ষা পেছানোর জন্য ধরনা দেওয়া হয় এবং অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ অপসারণের জন্য ছাত্ররা ঘেরাও-চড়াও করে। পরীক্ষা পেছানোর দাবি মিটিয়ে এবং দুটি পরীক্ষার মধ্যে কমপক্ষে তিন-তিন দিন ছুটি দিয়ে কেমন করে সেশনজট পরিহার করা যাবে! বড়ই দুঃখের ব্যাপার, বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আমাদের কোনো ক্যালেন্ডার নেই। এই বিষময় পরিস্থিতি থেকে একটা পরিত্রাণের পথ আমাদের বের করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বেশির ভাগই প্রাপ্তবয়স্ক। তারা সুকুমারমতি বালক-বালিকা নয়। তাদের স্বভাব-চরিত্র ইতিমধ্যে নির্দিষ্ট আকার গ্রহণ করেছে। তার পেছনে তাদের পিতা-মাতা-অভিভাবক ও স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের প্রভাব রয়েছে। ঘরের প্রভাব শিক্ষায়তন ও সমবয়স্কদের প্রভাবের চেয়ে কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আচার-ব্যবহারে শৃঙ্খলাবোধের প্রথম বিকাশ ঘটে পিতা-মাতার স্নেহ-শাসনে। এ-সম্পর্কে সামান্য ঔদাসীন্য ভয়ানক অকল্যাণ বয়ে আনতে পারে। এসব আপনাদের জানা কথা। অভিভাবকদের তাঁদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিতে আমি বড় কুণ্ঠা বোধ করি। সনদপ্রাপ্ত প্রকৌশলীদের পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের আজ আমি শুধু আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।

মেধাবী প্রকৌশলীরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে—এ নিয়ে আমি মাতম করতে রাজি না। আমরা যদি মেধাবী ছাত্রদের ধরে না রাখতে পারি, তাদের গবেষণার ক্ষেত্র প্রসারিত না করতে পারি বা তাদের কর্মসংস্থানের উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিতে পারি তাহলে তারা যদি ভাগ্যান্বেষণে বিদেশে পাড়ি দেয় আমি তাতে দোষের কিছু দেখি না। পিতা-মাতার ঋণ বা দেশমাতৃকার ঋণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের ঋণখেলাপি হিসেবে আমি চিহ্নিত করতে চাই না। পাকিস্তানের আবদুস সালাম বা আমাদের এফ আর খান দেশের জন্য যে সুনাম বয়ে এনেছিলেন তা তাঁরা বিদেশ না গেলে সম্ভব হতো কি না সন্দেহ। মেধা-নিঃসরণের ওপর বৃথা কান্নাকাটি না করে প্রবাসী প্রকৌশলীদের আমরা কেমন করে দেশে ফিরিয়ে আনতে আকৃষ্ট করতে পারি, সেদিকে আমাদের চিন্তা করাই ভালো।

আজ যাঁরা বিভিন্ন মানের সনদ পেলেন, তাঁদের জীবনে এক স্মরণীয় দিন। আমি আপনাদের অভিনন্দন জানাই। ছাত্রজীবন শেষ করে গার্হস্থ্য জীবনে প্রত্যাবর্তনের নাম সমাবর্তন। সমাবর্তনে ছাত্রজীবনের সমাপ্তি ঘটে বটে, কিন্তু শুরু হয় আত্মপ্রত্যয়ে হাতেকলমে শেখার নতুন জীবন। আজ প্রতিটি পেশার ক্ষেত্রে অবিরাম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন স্বীকৃতি হচ্ছে। পেশায় ক্রমোৎকর্ষ অর্জন করতে হলে প্রকৌশলীদেরও অবিরাম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিগত বিদ্যাকে হালনাগাদ করতে হবে। কর্মজীবন ও সংসার সে কঠিন জায়গা। তুলনামূলক নির্ঝঞ্ঝাট ছাত্রজীবন আজ শেষ হলো। সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। সংসারজীবনের ‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু’ পার হয়ে আপনারা সাফল্য অর্জন করবেন, এই আমি কামনা করি। আপনারা সকলে ভালো থাকুন। পরম করুণাময় আপনাদের সহায় হোন।

সূত্র: মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত বই শিক্ষার্থী ও শিক্ষাদাতাদের জয় হোক