লক্ষ্য ২০১৮

মডেল: তিথি ছবি: খালেদ সরকার
মডেল: তিথি ছবি: খালেদ সরকার

‘বাবু, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?’ ছোটবেলায় এই প্রশ্নের সম্মুখীন হননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কেউ হয়তো উত্তরে বলেছেন, ‘ডাক্তার হব’, ‘ইঞ্জিনিয়ার হব’ কিংবা ‘পাইলট হব’...। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আপনার জীবনের লক্ষ্যটা হয়তো বারবার বদলেছে। কিন্তু কখনো কখনো বড় লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আগে ছোট ছোট লক্ষ্য পূরণ করতে হয়। স্বপ্নের ছবিটা একটু ছোট ক্যানভাসে আঁকতে হয়। এই যে নতুন একটা বছর শুরু হলো, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরে পৌঁছানোর আগেই আপনি আপনার জীবনে কী কী পরিবর্তন যোগ করতে চান, সেটা কি ভেবেছেন? এ প্রশ্নটাই আমরা তরুণদের কাছে করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, ২০১৮ সালে তাঁদের লক্ষ্য কী? নানা জনের কাছ থাকা নানা রকম উত্তর পাওয়া গেল। তাঁদের উত্তরগুলো হয়তো আপনাকেও এ বছরের জন্য নিজের লক্ষ্য ঠিক করতে সাহায্য করবে।

তাহমিদ হোসাইন পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে। স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতি তাঁকে টানে। তাই পরীক্ষা বাদে সব সময় ওত পেতে থাকেন—কবে, কখন, কীভাবে ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। স্নাতক চতুর্থ বর্ষে পড়ুয়া এই শিক্ষার্থী যখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন, সে সময় তাঁর মাথায় চেপেছিল পাহাড়ে চড়ার ‘ভূত’। এখন তো রীতিমতো নেশা! ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ‘রক ক্লাইম্বিং কোর্স’ করেছেন। কেওক্রাডং দিয়ে শুরু। এরপর বাংলাদেশের পাহাড়গুলোতে তো চড়েছেনই, সেই সঙ্গে ভারতের উঁচু পাহাড়গুলোও বাদ পড়ছে না। ২০১৮ সালে তাঁর লক্ষ্য, এবার ভারতের নেহরু মাউন্টেইনারিং ইনস্টিটিউট থেকে পর্বতারোহণ কোর্স করবেন। আর অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব—দ্য কোয়েস্ট থেকে ইন্দো-বাংলা যৌথ পর্বতারোহণে অংশ নেবেন। এই ‘ছোট ছোট’ পর্বত পেরিয়েই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গে পা রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর শেষ করেছেন হৈমন্তী মজুমদার। এখন শুধু থিসিস বাকি। শেষ হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন তাঁর ২০১৮ সালের লক্ষ্য অর্জন করতে। পড়ছেন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্সে, তাই চিন্তাভাবনাটাও সুদূরপ্রসারী। এ বছরেই শেষ করবেন আইইএলটিএস ও জিআরই। হৈমন্তী বলছিলেন, ‘আপাতত ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে ঘরে বসেই টুকটাক পড়ছি। থিসিস শেষ হলে পুরোদমে শুরু করব।’ দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা তাঁর। তাই এ বছরের মধ্যেই ভাষাগত দক্ষতা পরীক্ষার ঝামেলাটা সেরে নিতে চান।

হৈমন্তী যেমন জোর দিচ্ছেন ইংরেজির ওপর, অন্যদিকে সামিয়া চৌধুরীর ২০১৮ সালের লক্ষ্যটা একটু ভিন্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের এই শিক্ষার্থী শিখতে চান চৈনিক ভাষা ম্যান্ডারিন। কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন চীন বিশ্বের বেশির ভাগ মার্কেট দখল করে ফেলছে। মোটামুটি সব দেশেই চীনের উদ্যোক্তারা জনপ্রিয়। এই উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ব্যবসা ও যোগাযোগের জন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠান ম্যান্ডারিনকে হয়তো বেশি প্রাধান্য দেবে। তাই ব্যবসা বা চাকরির ক্ষেত্রে তৃতীয় একটি ভাষা শেখা থাকলে খুব কাজে দেয়।’

বোঝা গেল, সমসাময়িক চাহিদার কথা ভেবেই তরুণেরা তাঁদের লক্ষ্য ঠিক করছেন। কেউ নতুন একটা কিছু শুরু করতে চান, কেউ বা বহুদিন থেকে করে আসা পরিশ্রমের ফল পেতে চান এ বছরের মধ্যে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের লক্ষ্যটা বলি, শুনুন। স্নাতকোত্তর প্রায় শেষের দিকে। লবণাক্ত পরিবেশে গম-বীজের অঙ্কুরোদ্‌গম কীভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে একটি গবেষণা করছেন মাহমুদুল। তাঁর ইচ্ছা, এ বছরের মধ্যেই গবেষণাপত্র প্রকাশ করবেন। তবে এটা তাঁর দ্বিতীয় লক্ষ্য। প্রথম লক্ষ্যটা কী? একটা সরকারি চাকরি পাওয়া। প্রস্তুতি নিচ্ছেন আরও আগে থেকে। তবে এ বছর চাকরিটা তাঁর চাই-ই চাই।

গ্রিন ইউনিভার্সিটির মার্কেটিং বিভাগের মালিহা ফাইরুজ নতুন নতুন জায়গায় ঘুরতে খুব পছন্দ করেন। এ বছরের পরিকল্পনায় দিনপঞ্জিতে দাগ কেটে রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন বলে। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি অর্থ সঞ্চয় করছেন এই ভ্রমণের জন্য। এবার সুযোগ এল বলে। ইউরোপ ভ্রমণের পরিকল্পনা মাথায় আছে। তবে এ বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রই লক্ষ্য। কোথায় কোথায় হানা দেবেন, এরই মধ্যে সেটির তালিকা তৈরি করে ফেলেছেন। নায়াগ্রা ফলস, ডিজনিল্যান্ড আর হলিউডে এ বছরই পা রাখতে চান তিনি।

কেউ কেউ আবার শুধু একটি নয়, একাধিক অর্জন চান এই ২০১৮ সালের মধ্যেই। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন সুমিত চন্দ। তাঁর প্রথম লক্ষ্য ‘সিমুলেশন’ অর্থাৎ ‘বাস্তব কোনো কিছুর থ্রিডি মডেল তৈরি করা’ শেখা। শেখার কাজটা হয়ে গেলেই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মন দেবেন তিনি। এটুকু বলেই অবশ্য সুমিত থেমে গেলেন না। বলতে থাকলেন, ‘আমার দ্বিতীয় লক্ষ্য ভারতের আইআইটিতে টেকফেস্ট ও টেককৃতি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা। দেশে কোন কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া যায়, সেটারও তালিকা তৈরি করছি। তৃতীয় লক্ষ্য, হিমালয়ের কাছাকাছি ৫ থেকে ৬ হাজার মিটার উচ্চতার পর্বতে চড়ব। চতুর্থ লক্ষ্য, সাতক্ষীরার ভোমরা বন্দর থেকে সিলেট তামাবিল সীমানা পর্যন্ত সাইক্লিং করব। বান্দরবানে ঝরনার খোঁজে একটা অভিযানে নামার ইচ্ছাও আছে...।’ ‘থামুন থামুন। বছরে তো কেবল ৩৬৫টা দিন। এত্ত কিছু করবেন কীভাবে?’ আঁতকে উঠে জানতে চাই সুমিতের কাছে। হেসে বললেন, ‘সময় ভাগ করা আছে। পর্বত অভিযান রোজার ছুটিতে, সাইক্লিং কোরবানির ছুটিতে, ঝরনার খোঁজে বর্ষাকালে, সিমুলেশন শেখা হবে সারা বছর পড়ার ফাঁকে ফাঁকে, আর প্রতিযোগিতাগুলোতে অংশ নিতে হলে ক্লাস বাদ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।’

এই না হলে তরুণ! ‘ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, ঝর্ণার মতো চঞ্চল’ বলেই এই তরুণেরা লক্ষ্য ঠিক করতে ভয় পান না। কে জানে, হয়তো এ বছরই সুমিত কিংবা তাহমিদের ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুঁ মারলে তাঁদের অভিযানের ছবি দেখা যাবে। মালিহা চেক ইন দেবেন ডিজনিল্যান্ড থেকে। মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের গবেষণার খবর হয়তো আমরা প্রথম আলোর পাতায় দেখতে পাব। আইইএলটিএস বা জিআরইতে দারুণ একটা স্কোর তুলে হৈমন্তী হয়তো সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবেন, সামিয়া অনর্গল কথা বলবেন ম্যান্ডারিন ভাষায়! এই তরুণদের জন্য শুভকামনা। পাঠক, শুভকামনা আপনার জন্যও।

বড় লক্ষ্য পূরণের জন্য ছোট ছোট লক্ষ্য দরকার

ওসামা বিন নূর,

ইয়ুথ অপরচুনিটিজের প্রতিষ্ঠাতা

বড় লক্ষ্য পূরণের জন্য ছোট ছোট লক্ষ্য পূরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে পৌঁছাতে চাই, সেখানে যেতে হলে হয়তো আমার কিছু প্রস্তুতি দরকার, নিজেকে তৈরি করা দরকার। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যেই কিছু স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা করে নিতে হয়। আমি ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজে ‘নেতৃত্ব’ বিষয়ে এক বছর পড়ালেখা করেছি। সেখানে কোর্সের শেষে এসে আমাকে বলতে হয়েছে, ৩ বছর পর আমি কোথায় যেতে চাই, ১ বছর পর কী করতে চাই, ৫ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চাই। এভাবে পরিকল্পনা করা খুব জরুরি।