রূপানন্দার পিএইচডি লাভ

রূপানন্দা রায় l ছবি: সংগৃহীত
রূপানন্দা রায় l ছবি: সংগৃহীত

রাঙামাটি শহরে জন্ম মেয়েটির। সেখানেই বেড়ে ওঠা। বাবার কাজের সূত্রে একসময় ঢাকায় চলে আসতে হয়। এখানেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক। চাকমা জাতিগোষ্ঠীর এই মেয়ে একসময় বৃত্তি নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করলেন, গত বছর পিএইচডি ডিগ্রিও অর্জন করলেন তিনি।

বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমন একটি অর্জন যেকোনো মানুষের জন্য মর্যাদার। কিন্তু রূপানন্দা রায়ের এ অর্জনে এক নতুন ইতিহাস তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে যে ৫০টির বেশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের ভেতরে রূপানন্দা প্রথম নারী, যিনি এ ডিগ্রি অর্জন করলেন।

অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেড থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছেন তিনি। সেখান থেকে ফোনে বলছিলেন, আনন্দ আর কষ্টের দুই রকম অনুভূতিই আছে। আনন্দটা হলো, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভেতরে প্রথম নারী হিসেবে এমন অর্জন হলো। আর কষ্টটা হলো, এত দিন পর এই অর্জন হলো। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই জনগোষ্ঠীর নারীদের অনেক পিছিয়ে থাকার চিত্র এটি।

রাঙামাটি শহরের রাজবাড়ি এলাকার বিক্রম রায়-বিপাশা রায় দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে রূপানন্দা ছোট। বিক্রম রায় অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছিলেন ২০০৭ সালে। এখানে পড়ার সময় ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকারের বৃত্তি পান। পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে। ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডিলেড থেকে ২০১২ সালে প্রথম শ্রেণি পেয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তখনই তিনি পিএইচডি করার কথা ভাবতে থাকেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী স্নাতকে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের জন্য পিএইচডি করার সুযোগ থাকে। তাঁর পিএইচডির বিষয় ছিল বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিক-সংক্রান্ত নীতিমালার মূল্যায়ন।

স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে রূপানন্দা রায়
স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে রূপানন্দা রায়

পিএইচডির বিষয় কেন এটি হলো? রূপানন্দার উত্তর, ‘এও নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই পাওয়া। যখনই দেশে গেছি, বিমানবন্দরে দেখেছি ইমিগ্রেশনে প্রবাসী শ্রমিকদের দীর্ঘ সারি। আমরা ইমিগ্রেশন সহজেই পার হচ্ছি, অথচ তাদের অপেক্ষা ফুরায় না।’ রূপানন্দা বলেন, ‘দীর্ঘ ভ্রমণ শেষ করে স্বজনদের কাছে যাওয়ার জন্য মুখগুলো আমাকে কষ্ট দিত। আমি এ সমস্যার স্বরূপটা দেখতে চেয়েছিলাম।’

বিষয় নির্বাচন করার পর রূপানন্দার শিক্ষকেরাও এর প্রশংসা করেন। তিনি তাঁর গবেষণায় বাংলাদেশের শ্রমিক অভিবাসন নীতির বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবগুলো তুলে ধরেছেন। এ গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো, ১৯৯০ সালের পর গণতান্ত্রিক ধারায় বাংলাদেশের উত্তরণের সময় থেকেই  রাজনৈতিক নেতৃত্ব দারিদ্র্যবান্ধব নীতি নেওয়া শুরু করে। অভিবাসী শ্রমিকদের জন্যও এর ফলে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হতে থাকে। তবে তাঁর আরেক পর্যবেক্ষণ হলো, সরকারের উচিত দ্রুত অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য আরও পরিষেবা বাড়ানো এবং সেই সঙ্গে নীতিগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন। এর ক্ষেত্রগুলোও তিনি তুলে ধরেছেন।

গবেষণার কাজে ছয় মাস বাংলাদেশে ছিলেন রূপানন্দা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে জমা দেন পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর সমাবর্তনে তাঁকে ডিগ্রি দেওয়া হয়।

এত দূর এগিয়ে যাওয়ার পেছনে বাবা-মা, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির মানুষের অকুণ্ঠ সহযোগিতা ও অস্ট্রেলিয়া সরকারের বৃত্তির কথা বললেন তিনি। মেয়ের এ অর্জনে স্বভাবতই খুশি রূপানন্দার বাবা বিক্রম রায়। বললেন, ‘ও ওর মেধার স্বীকৃতি পেয়েছে। সব সময় পরিশ্রমী ছিল। তার দামই পেয়েছে।’ রূপানন্দার স্বামী রিপন তঞ্চ্যঙ্গা পেশায় একজন চিকিৎসক। তাঁদের মেয়ে পার্নিতার বয়স ১০ মাস।

রূপানন্দা যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সেই অঞ্চল ছিল অশান্ত। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পর ২০০৩ সাল থেকে সেখানে বড় আকারে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হয়। তারপরও সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উপাত্ত বলছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, বাসস্থানের মতো মৌলিক নানা সুযোগ থেকে এ অঞ্চল ও এর মানুষ এখনো জাতীয় মানেই পৌঁছায়নি।

পাহাড়ের এই পশ্চাৎপদতা রূপানন্দাকে তাঁর লক্ষ্য ঠিক করতে সহায়তা করে। দেশে ফিরে উন্নয়ন খাতে কাজ করতে চান তিনি। তাঁর কথা, এই ডিগ্রি অর্জন তাঁকে খ্যাতি দিয়েছে মাত্র। এর যথার্থতা তিনি দেখাতে চান মানুষের জন্য কাজ করে।

পাহাড় ও সমতল মিলিয়ে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। এত জাতিসত্তার মধ্যে এক নারীর এ অর্জন আপ্লুত করেছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রংকে। তিনি বলেন, রূপানন্দা এসব জাতির নারীদের উদ্দীপ্ত করেছেন।

এখন তাঁর অভিসন্দর্ভটি বই আকারে প্রকাশের কাজ করছেন। সেটি শেষ হলে দেশে ফিরবেন রূপানন্দা।