আমার বোন, স্ত্রী ও কন্যাকে ধন্যবাদ

নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করে মীর ফাউন্ডেশন নামে ভারতের একটি অলাভজনক সংস্থা। তাদের মাধ্যমে অ্যাসিডদগ্ধ নারী ও শিশুদের পাশে দাঁড়িয়েছেন শাহরুখ খান। মানবতার জন্য এই কার্যক্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ গত ২২ জানুয়ারি তাঁকে সম্মানিত করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। পড়ুন সেই অনুষ্ঠানে এই বলিউড তারকার দেওয়া বক্তব্য
শাহরুখ খান
শাহরুখ খান

আমি সত্যিই গভীরভাবে কৃতজ্ঞ এই সম্মানের জন্য। আরও বেশি কৃতজ্ঞতা এই জন্য যে, দুজন অসাধারণ মেধাবী মানুষের সঙ্গে একই কাতারে দাঁড়ানোর সুযোগ আজ হলো—কেট ব্ল্যানচেট ও এলটন জন। একটা অনুরোধ। জানি, এই পর্যায়ে এসে আমি আমার সন্তানদের বিব্রত করছি। তবু বলি, আপনারা যাওয়ার আগে আমি কি আপনাদের সঙ্গে একটা সেলফি তুলতে পারি?
অভিনয়শিল্পীরা ভীষণ আত্মপ্রেমী হন। যতই বলি না কেন বাহ্যিক সৌন্দর্য আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবু কোনো না কোনোভাবে এটাই আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে যায়। সৌন্দর্যের যে চিরায়ত ধারণা আমাদের মনে গড়ে উঠেছে, আমার সেই ধারণা বদলে দিয়েছিলেন একজন অ্যাসিডদগ্ধ নারী। কয়েক বছর আগে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।
আমার কাছে একজন নারীর মুখে অ্যাসিড নিক্ষেপ করা হলো সবচেয়ে নিকৃষ্ট আর ঘৃণ্য কাজ। একজন নারীর তাঁর নিজের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই—এমনটা যারা ভাবে, তারাই এই ঘৃণ্য অপরাধ করতে পারে। অথচ আমি আজ পর্যন্ত যত জন অ্যাসিডদগ্ধ নারীর মুখোমুখি হয়েছি, আমি দেখেছি তাঁদের অগ্রযাত্রা থেমে নেই। যেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে তা হলো, আমি দেখেছি, জীবনের এই ধাক্কা তাঁদের আরও বেশি সাহসী, শক্তিশালী আর স্বাধীন করেছে। তাঁদের কাছে আমি শিখেছি, কীভাবে মনের জোর একটা মানুষকে ভুক্তভোগী থেকে নায়কোচিত করে। কীভাবে সহনশীলতা নয়; বরং সংহতি মানুষকে খারাপ সময় কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। মানুষের জীবনে সমতা কেবল একটা ধারণা নয়, একটা সত্য। আমি শিখেছি, অন্যের জন্য কিছু করার মানসিকতা স্রেফ ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, এটা আমাদের দায়িত্ব।
মীর ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে যেসব সাহসী নারী ও শিশুর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, তারা আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে সবার যা পাওয়ার কথা, তা কেউ পায়, কেউ পায় না। আমার মতো কেউ কেউ ঘটনাক্রমে পেয়ে যায়। আবার এখানে আপনারা যাঁরা উপস্থিত আছেন, আপনাদের মতো অনেকে মেধা দিয়ে এসব অর্জন করে নেন। আপনারা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষের মধ্যে পড়েন। খানিকটা সংকোচ নিয়ে বলতে চাই, ক্ষমতাকে আমরা যেভাবে ব্যবহার করি, আজকের পৃথিবীতে এটাকে সম্পূর্ণ অন্যভাবে ব্যবহার করার কথা।
এখানে আসার আগে আমি আমার ৫ বছর বয়সী ছেলেটার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলাম। সে হঠাৎ বলল, ‘পাপা, পাপা, আমার চোখটা চুলের মধ্যে পড়ে গেছে। তুমি কি চুল থেকে চোখটা সরিয়ে দিতে পারো?’ সে কিন্তু বলেনি চোখ থেকে চুল সরিয়ে দাও, যেমনটা আমরা বলি। ব্যাপারটা অনেকটা ক্ষমতার মতোই। আমরা ভাবি, ক্ষমতা পেলেই অনেক কিছু আমাদের পথে এসে পড়ে। আসলে ক্ষমতাই এই পথগুলো বেছে নেয়।
ক্ষমতা হাতে পেলে আমরা ধরে নিই, সব ধরনের সুবিধা ভোগ করার অধিকার আমার আছে। আমরা সুযোগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। সামনে এগোনোর পথ থেকে বাধা দূর করতে গিয়ে আমরা সেই মানুষগুলোকে দূরে সরিয়ে দিই, যাঁরা আমাদের এই নাম, যশ, খ্যাতি দিয়েছেন। অথচ এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আমাদের নিশ্চিত করার কথা, যেন পথটা সবার হয়। যেখানে সুবিধাবঞ্চিত বা সুবিধাভোগী বলে কিছু নেই, যেখানে সবাই সমান। সেই সুন্দর মুখশ্রীর নারীর কাছ থেকেই আমি এই শিক্ষা পেয়েছি। আজ সেই নারী ও শিশুদের কৃতজ্ঞতা জানাই, যারা আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিল। এই পুরস্কারের মাধ্যমে আজ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম আসলে তাদের কাছ থেকে পাওয়া সাহসিকতাকেই স্বীকৃতি দিল।
আমি আমার বোন, স্ত্রী আর আমার ছোট্ট কন্যাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। কারণ, তারা আমাকে মূল্যবোধ শিখিয়েছে। আমি শিখেছি, জোর করে নয়; বরং অনুরোধ করে, কখনো কখনো মিনতি করে একজন নারীর সম্মতি আদায় করতে হয়।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ:
মো. সাইফুল্লাহ
সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস